কুণাল ঘোষ, লন্ডন: মার্চ, ১৯৭৫। দমদম বিমানবন্দরে এক চিকিৎসককে বিদায় জানাতে এসেছিল তাঁর বালকপুত্র। ডা. কল্যাণ ঘোষ লন্ডন গেলেন, পাক্কা এক বছরের জন্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশেষ প্রশিক্ষণ। নিউক্লিয়ার মেডিসিনে। মনে আছে, সেই একটা বছর বাবার দেখা নেই। ডাকে আসত চিঠি, রঙিন ছবির কার্ড। কখনও সখনও ট্রাঙ্ক কল। দূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ। স্মৃতিতে সব আবছায়া।
এখন, পঞ্চাশ বছর পর, এই ২০২৫-এর মার্চ, সেই লন্ডন সফর আমার। ধন্যবাদ মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, তাঁর প্রতিনিধিদলে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য; এবং সংবাদ প্রতিদিনকে, আমার সফরের আর্থিক ব্যবস্থার জন্য। আমি আগেও একাধিকবার লন্ডন গিয়েছি। কিন্তু বাবার সফরের ঠিক ৫০ বছর পর এই সফরে খানিকটা ব্যক্তিগত আবেগ অনুভব করছি, যার সঙ্গে নানারকম পুরনো কথা জড়িয়ে রয়েছে।
অর্ধশতক আগে বিলেতে থাকা বাবার সঙ্গে দেখার প্রশ্ন ছিল না। চিঠি, মাঝেমধ্যে ট্রাঙ্ক কল। ওইটুকুই। এখন দিন বদলেছে, এখন সফরের আগে সম্পাদকীয় বৈঠক করে যাচ্ছি। মোবাইল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অবিরাম যোগাযোগ, খবর, ছবি আসবে। অভিজিৎ ঘোষ, অরিঞ্জয় বোসের কড়া আবদার, নির্দেশ বলাই ভালো, ডিজিটালের জন্য ভিডিও চাই নিয়মিত, ফেসবুক লাইভও দরকার। প্যাকেজ হবে, রিলস হবে। হাতের ফোন আন্তর্জাতিক রোমিং হয়ে গিয়েছে। কাজ শুরু ইতিমধ্যেই। আরও তথ্য, এখন দুবাই-লন্ডন রুট বা আন্তর্জাতিক বড় রুটে পাঁচ ডলার বা আরেকটু বেশি খরচ করলে আকাশপথেও সারাক্ষণ মোবাইল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, নেট কাজ করবে। ভূপৃষ্ঠ থেকে চল্লিশ হাজার ফুট উপরে বিপুল গতির বিমানে বসে কলকাতায় খবর নেওয়া যাবে, কাগজের পাতা তৈরি কতটা এগোল!!
লন্ডনে আমি প্রথম যাই ২০০৫-এ, এয়ার ইন্ডিয়ার অতিথি হিসাবে। কলকাতা থেকে লন্ডন সরাসরি প্রথম উড়ানের যাত্রী। কিছুদিন পরেই অবশ্য সরাসরি উড়ানটি যাত্রীর অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এরপরও পাঁচবার। দুটো মনে রাখার মতো, লেখার মতো বিষয়। এক, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিশ্বকবির বিলেতবাড়ি দর্শন এবং জরুরিভিত্তিতে আয়োজনে কবির জন্মসার্ধশতবর্ষের প্রথম অনুষ্ঠানটি হ্যাম্পস্টেডের ওই বাড়িতে, পাশের টাউন হলে করার। ওই ঠান্ডা রাতে বৃষ্টিভেজা ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণে লোপামুদ্রা মিত্রর ‘তবু মনে রেখো’ সারাজীবন মনে রাখব। দুই, সেই অর্ধশতক আগে বাবা লন্ডন থেকে একটি বই এনেছিলেন আমার জন্য, ‘কালারফুল লন্ডন’। শহরটার নানা ছবি, পরিচিতি। একটি মোড়ের ছবি দারুণ লাগল। কেমন যেন শ্যামবাজার শ্যামবাজার ভাব। রাস্তাগুলোর মাঝখানের মূর্তিটি ডানাওলা মূর্তির। ওই জায়গাটা মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল। তখন অবশ্য মূর্তির অর্থ, পরিচয়, তাৎপর্য বুঝিনি। সেটা ক্রমশ বুঝেছি পরে। এরপর ১৯৮৪, তখন রীতিমতো নিয়মিত আঁকি, শিল্পী-শিক্ষক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে একটি প্রদর্শনীতে আমার চারটি ছবি ছিল। তার মধ্যে সেই রাস্তার মোড়, পিকাডেলি সার্কাসের ছবিটি তৎকালীন ইংরেজি স্টেটসম্যান কাগজের রিভিউতে প্রশংসা পেল। ভাবতাম ওই ডানাওলা মূর্তির সামনে একদিন যদি যেতে পারতাম! এরপর সময় কেটেছে, বাবা সেই নিউক্লিয়ার মেডিসিন গবেষণা চালাতে গিয়ে তেজস্ক্রিয়তায় কিডনি-সহ অঙ্গ বিপর্যয়ে প্রয়াত; একদিন রূপকথার সত্যি হওয়ার মতো সময় এল, ২০০৫-এ দেখলাম বাবার এনে দেওয়া সেই বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা সেই রাস্তার মোড়ের মাঝখানে, সেই ডানাওলা মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যে মূর্তি গ্রিক দেববংশের ইরোজের ছায়ায় তৈরি, যার আনুষ্ঠানিক নাম স্যাফটসবেরি মেমোরিয়াল ফাউন্টেন। মূর্তিটি অসাধারণ, ভালোবাসার দেবতা ইরোজ, বহু কাহিনি মূর্তি নিয়ে, ডানায় যেন ইচ্ছেপূরণ আর তিরধনুকে লক্ষ্যভেদ, স্থাপত্যটি এখন পায়রাদেরও প্রিয়, ভরপুর প্রতীকী। বাল্যকালের দেখা ছবির মূর্তির সামনে দাঁড়ানোটা এক বিচিত্র অনুভূতির। জীবন ভারি অবাক করা সফরনামা। তারপরেও একাধিকবার এসেছি এই মূর্তির কাছে, এবং, এবারেও এখন রবিবার লন্ডনের মেঘলা দুপুরে দাঁড়িয়ে আছি সেই পিকাডেলি সার্কাসে, সেই মূর্তির সামনে।
সময়ের স্রোতে নানা ঝড়বৃষ্টি, উত্থানপতন, স্বর্গনরক দেখার পর আজ আবার লন্ডন সফরে। সপ্তমবারের জন্য। বাংলার মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসাবে, সাংবাদিকতার কর্তব্যপালনেও বটে। পেশাগত কারণে নানা দেশে গিয়েছি, বিশিষ্টদের সঙ্গে সফরের সুযোগ হয়েছে, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বিশেষ বিমানে মরিশাস সফরও মনে রাখার; কিন্তু হয়তো বাল্যকালের যোগাযোগের জন্য, ফোন বাজলেই কৌতূহল: লন্ডন থেকে বাবার ফোন? ওই শহরটা কোথাও যেন মায়াভরা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু থেকে গিয়েছে। এখন এবারের সফরের অভিজ্ঞতার পালা। শনিবার রাতে কলকাতা থেকে দুবাই। মাঝরাতেই লন্ডনের উড়ান। এ৩৮০, দোতলা বৃহত্তম যাত্রীবাহী বিমান। যতবার দেখি, বিস্ময় জাগে। ভিতরে উচ্চমানের খাদ্য, পানীয়, নানা সুবিধা। আর প্রযুক্তির উন্নতি। প্রতি যাত্রীর নিজস্ব স্ক্রিন, তাতে হেডফোন লাগিয়ে পছন্দের সিনেমা, গান, টিভি শো। বাংলা সিনেমাও আছে এদের স্টকে। তবে সবচেয়ে ভালো এয়ার শো। ম্যাপ দেখাবে, বিমান কোথায় রয়েছে। আর বিমানের বাইরের দিকের তিনটি ক্যামেরা সামনের লাইভ ছবি দেখাচ্ছে। একটি সামনের চাকা থেকে ফ্রন্ট, একটি পেটের কাছ থেকে ভূপৃষ্ঠ, অন্যটি লেজের উপরে বসানো, সেটা থেকে গোটা প্লেনের ভিউ। মহাকাশের মেঘের খেলা, টেক অফ, ল্যান্ডিংয়ের সময়ের লাইভ দৃশ্যপট। যতবার দেখি, অবাক হয়ে দেখতেই থাকি। বিজ্ঞান, প্রযুক্তির জাদুর খেলা। এই প্রবল অগ্রগতি, আধুনিকতার বিস্ময়ের মধ্যেই লন্ডন স্মৃতিতে কোথাও যেন এক বাল্যস্মৃতির টান। লন্ডন ঘুমের মধ্যেও যেন জেগে থাকে। হাতছানি দেয় অতীতের মায়ালোকে। আমি লন্ডনে এসেছি অনুভূতির থেকেও বেশি মনে হচ্ছে এক বালক তার বাবাকে সি অফ করতে দমদম বিমানবন্দরে দাঁড়িয়েছে, বাবা এক দূরের শহরে যাচ্ছেন। সেই অধরা দূরের কল্পনার আবেশটাই যেন আজ বারবার মনের ক্যানভাসে আবছা ছবি আঁকছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.