রমেন দাস: দু’দশকের বেশি সময় কেটে গিয়েছে। তবু মহাকাশ যাত্রা নিয়ে আমাদের আতঙ্ক কাটেনি। আমাদের স্মৃতিতে এখনও টাটকা ভারতীয় বংশোদ্ভূত নভোচর কল্পনা চাওলার মর্মান্তিক মৃত্যু। ২০০৩ সালে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ফেরার পথে মহাশূন্যেই হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। পৃথিবীতে ঝরে পড়েছিল শুধু ভস্ম! ২২ বছর পর, মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন থেকে রকেটে করে পৃথিবীর পথে আরেক ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুনীতা উইলিয়ামস ও তাঁর সহকর্মী বুচ উইলমোর। ভারতীয় সময়ে বুধবার রাত প্রায় সাড়ে ৩টেয় আমেরিকার ফ্লোরিডার উপকূলে তাঁদের অবতরণের কথা। স্বয়ংক্রিয় মহাকাশযানে এই যাত্রাপথটা আপাত নিরাপদ, কিন্তু কল্পনা-হারানোর স্মৃতি যে বারবার ধাক্কা দেয়! তাই তাঁরা পৃথিবীর মাটিতে পা না রাখা পর্যন্ত চাপা টেনশন থাকবে। ৯ মাস পর দুই নভোচরের ফেরার পথে কোথায়, কতটা ঝুঁকি, সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে ফোনে সেসব ব্যাখ্যাই করলেন অধ্যাপক সন্দীপ চক্রবর্তী, জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী এবং ভারতীয় মহাকাশ ভৌতবিজ্ঞান কেন্দ্রের ডিরেক্টর।
অধ্যাপক সন্দীপ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, মঙ্গলবার যখন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে সুনীতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোরকে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়, ভারতীয় সময় তখন সকাল প্রায় ৮ টা ১৫। স্পেস স্টেশন ও ফ্যালকন নাইন রকেটকে ডক করে প্রথমে সমস্ত যন্ত্রাংশ লক করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ যাতে বাইরের বাতাস ভিতরে আসতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা হয়। সুনীতা, বুচরা উপযুক্ত পোশাক পরে রকেটে প্রবেশ করেন। তারপর শুরু হল আনডকিংয়ের প্রক্রিয়া। ১২টি লক খুলে দেওয়া হয়, তাতে স্পেস স্টেশন ও রকেট মডিউলকে পৃথক করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে স্পেস স্টেস স্টেশন থেকে ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে সরে যায় ফ্যালকন নাইন। এরপর পৃথিবী থেকে ৪২৭ কিলোমিটার দূর থেকে রকেট যাত্রা শুরু করে পৃথিবীর দিকে। এখানে একটা পর্বে ইতি।
টানা ১৭ ঘণ্টা ধরে যাত্রাপথের শেষ কয়েকঘণ্টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবী থেকে ১০০ কিলোমিটার দূর থেকে রকেট থেকে মডিউলটি পৃথক হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে তা প্রবেশ করায় এই সময়ে গতিবেগও বেশি থাকবে। উষ্ণ হাওয়া, প্লাজমা, রেডিও তরঙ্গ – সবকিছুর প্রভাবে ধীরে ধীরে প্রোপেল্যান্ট অর্থাৎ রকেটের মূল চালিকাযন্ত্রটি পৃথক হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে উলটোমুখী হয়ে রকেটের মডিউল নভোচরদের নিয়ে হু হু গতিতে নেমে আসতে থাকবে পৃথিবীর দিকে। শেষদিকে গতি কমতে থাকবে। এবার মসৃণ অবতরণের সময়। মডিউল থেকে প্যারাশুটে নভোচররা বেরিয়ে আসবেন, ঝাঁপ দেবেন ফ্লোরিডা উপকূলের জলভাগে। সেখানে তৈরি থাকবে জাহাজ, কপ্টার। নভোচরদের সাবধানে নামিয়ে আনা হবে।
এই গোটা পদ্ধতিতে সবচেয়ে জরুরি অংশ শেষের ‘মসৃণ অবতরণ’। মহাকাশযান হোক কিংবা বিমান, সবক্ষেত্রে এই অংশে অতি সাবধানতা প্রয়োজন। এখানেই সবচেয়ে ঝুঁকি থাকে। তবে অধ্যাপক সন্দীপ চক্রবর্তীর কথায়, ”প্রতি ক্ষেত্রে স্পেস শাটলের অবতরণ এমনই হয়। এবারও নতুন কিছু ঘটবে না। সবটাই স্বয়ংক্রিয়। রকেট যদি কোনওভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়, তবে নভোচররা ভিতর থেকে তা দেখবেন। নইলে এই সময়টুকু তাঁদেরও কিছু করার নেই।”
তাহলে ২০০৩ সালে কল্পনা চাওলাদের প্রাণঘাতী বিপদে পড়তে হল কেন? এর জবাবে অধ্যাপক চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, ”যে স্পেস শাটলটিতে তাঁরা ফিরছিলেন, তা যাত্রার শুরু থেকেই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। একটি-দুটি স্ল্যাব আলগা হয়ে খুলে গিয়েছিল। পৃথিবীর কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণ বায়ু তার মধ্যে ঢুকে শিল্ড ভেঙে যায়। মহাকাশযানটি ভেঙে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তবে এবার তেমন হওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই। স্পেস এক্সের ড্রাগন ক্যাপসুলটি ভালোভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। ওখানে কোনও সমস্যা নেই।” ‘বুধে পা’ রেখে পৃথিবীতে সুনীতাদের সফল অবতরণের অপেক্ষায় সকলে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.