স্টাফ রিপোর্টার: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যা খুশি বলা যায়! তবু বাম জমানার সমালোচনা করা যাবে না! চৈত্র শেষের সন্ধেয় জিডি বিড়লা সভাঘরে দেশ পত্রিকার বিতর্কসভায় বিরাজ করছিল অদ্ভুত অদৃশ্য এক সুতো। যা টেনে ছিঁড়ে ফেললেন প্রাক্তন সাংসদ কুণাল ঘোষ। শুক্রর সন্ধ্যায় দেশ পত্রিকা আয়োজিত বিতর্কসভার বিষয়, ‘এখন বাংলায় রাজনীতি মানেই দুর্নীতি।’ চারজন পক্ষে। চারজন বিপক্ষে। অনুষ্ঠানের সূচনা করেন দেশ পত্রিকার সম্পাদক সুমন সেনগুপ্ত।
শুরু থেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কুরুচিকর বিশেষণ ছুড়ছিলেন আইনজীবী কৌস্তভ বাগচি, সিপিএম নেতা শতরূপ ঘোষ। সঞ্চালক চিকিৎসক কুণাল সরকার তারিফ করছিলেন সেসব বক্তব্যের। অথচ কুণাল ঘোষ বাম জমানার কেলেঙ্কারি তুলতেই একশ্রেণির দর্শক রে রে করে উঠলেন। কুণালকে তাঁদের নিশানা, ‘‘আপনি তো রাজনীতি করছেন। ওসব বলা যাবে না।’’ সঞ্চালকের মধ্যে তখন অদ্ভুত নীরবতা। যা নিয়ে কুণাল ঘোষ সাফ বলে দেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যখন অশালীন কথা বলা হচ্ছিল এক শ্রেণির দর্শক হাততালি দিচ্ছিলেন। আর আমি বাম জমানার সমালোচনা করতেই তাঁরা আমায় থামিয়ে দিলেন! সঞ্চালক বললেন তীক্ষ্ণ ভাষণ। আর আমি যখন বাম জমানা, বিজেপির কথা বলছি, তখন আমি রাজনীতি করব না! এ কেমন সহিষ্ণুতা?”
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ শুরু হয় সভা। সবার শেষে যখন কুণাল পোডিয়ামের সামনে উঠছেন, দাঁতে নখ কাটছিল পরিপূর্ণ পেক্ষাগৃহ। সিপিএম সমর্থকদের বুক দুরু দুরু। ক্রিজ ছেড়ে বেরোলেন কুণাল। কিন্তু গোটা দশ মিনিটও তাঁকে বলতে দেয়নি সিপিএম-কংগ্রেস সমর্থকরা। রীতিমতো হল্লা করে তাঁর বক্তব্য থামিয়ে দেওয়া হয়। বিস্মিত কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করা বাংলার বুকে একটা বিতর্ক সভায় এ কোন শ্রেণির দর্শক?’’
নিয়ম অনুযায়ী আমন্ত্রণপত্র ছাড়া এ অনুষ্ঠানে প্রবেশ করা যেত না। কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘রীতিমতো পরিকল্পনা করে এই বিতর্কসভায় লোক ঢোকানো হয়েছিল।’’ তবে আমন্ত্রণ করার জন্য দেশ পত্রিকাকে ধন্যবাদও দিয়েছেন কুণাল। সেই সঙ্গেই পরিস্থিতির কথা তুলে পরে বলেন, “বাদানুবাদের মধ্যেই তাঁরা তেড়ে এলেন। আমিও এগিয়ে তঁাদের যা বলার, বোঝাবার চেষ্টা করলাম। তুলকালাম কাণ্ড হল।” কুণালের বক্তব্য, “আমি তো একা গিয়েছি। আমি তাঁদের বলেছি, আপনারা কোথাকার ভাড়াটে!” এই শুনেই আক্রমণ আরও তীব্র হয়। কুণালের কথায়, “ওঁরা বললেন, আপনি দর্শকদের ভাড়াটে বলছেন। আমি বললাম, দর্শকদের কেন ভাড়াটে বলব! দর্শকদের নিয়ে আমার বারো মাসের কারবার। আমার জীবনের কারবার। যে ব্যক্তিরা মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়কে বা তৃণমূলকে খারাপ কথা বললে হাততালি দিচ্ছিলেন, আর আমি বাম জমানার কথা বললেই আমায় বাধা দিচ্ছিলেন তাঁদের ভাড়াটে বলেছি। যে প্যানেল নিয়ে কথা হচ্ছে, বক্তারা তাঁর তাঁর কথা বলবেন, সেখানে সিপিএমের বিরুদ্ধে, বিজেপির বিরুদ্ধে বলা যাবে না!” কুণালের আক্ষেপ, “কাগজে বিজ্ঞাপন ছিল, কার্ড নিয়ে ঢোকার। অর্গানাইজ করে লোক ঢোকানো হয়েছে। এটা চূড়ান্ত দুর্ভাগ্যজনক।” মাত্র ছ’মিনিট একচল্লিশ সেকেন্ড বলতে পেরেছেন কুণাল। তার মধ্যে যা হিসাব দিয়েছেন তাতেই বাম জমানার হাড় জিরজিরে চেহারাটা সামনে। মনে করিয়ে দেন, তিলোত্তমার হাড়হিম করা রেপসিড অয়েল কেলেঙ্কারির কথা। যা বিক্রির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল তৎকালীন সিপিএম নেতা প্রশান্ত শূরের ছেলে। এসএসকেএমের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানকে চাপ দেওয়া হয়েছিল, ভুল রিপোর্ট দিতে। ‘পিজির ডিরেক্টর করে দেব’– এমন ললিপপ দেখিয়েছিলেন তৎকালীন বাম জমানার মন্ত্রীরা। ডা. কল্যাণকুমার ঘোষ মাথা নত করেননি। রিপোর্ট দিয়েছিলেন, ‘‘ওই তেলে দোষ আছে।’’ সেই চিকিৎসক কল্যাণকুমার ঘোষের পুত্র কুণাল মঞ্চে এদিন বলেন, ‘‘আজ দুর্নীতি নিয়ে কারা বলছেন? যাঁদের বুক অবধি দুর্নীতির পাঁকে।’’
কুণালের বক্তব্যের মাঝেই অস্ফুট মন্তব্য করতে শোনা যায় আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে। টিপ্পনী কেটেছেন কুণাল, ‘‘অবসাদ আসা স্বাভাবিক। বিকাশবাবুর পায়ের কাছে বসে আইন শিখে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কিনা বিজেপিতে চলে গেলেন!’’ অভিনেতা বাদশা মৈত্রর প্রশ্নের উত্তরে আরও চাঁচাছোলা কুণাল, ‘‘আটের দশকে কারা কম্পিউটার ঢুকতে দেওয়ার বিরোধিতা করে জঙ্গি আন্দোলনে নেমেছিল? কারা গড়িয়াহাটে হংকং ব্যাঙ্কে ভাঙচূর করেছিল?’’– এসব প্রশ্ন করতেই বক্তবে্যর মাঝে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেন একদল দর্শক। কেন? সমঝদার শ্রোতারা বলছেন, “এমন সপাট জবাব হজম হয়নি।” চেঁচামেচি করে কুণালকে বারবার আটকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু যেটুকু সময় পেয়েছেন ‘টু দ্য পয়েন্টে’ উত্তর দিয়েছেন প্রাক্তন সাংসদ।
শতরূপ ঘোষ, বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, কৌস্তভ বাগচিরা যখন মুখ্যমন্ত্রীকে ব্যক্তিগত আক্রমণকেই অস্ত্র করেছিলেন তখন চুপ থাকেননি মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ও। বলেছেন, দুর্নীতি যারা করছে তাদের শাস্তি হোক, আমিও চাই। কিন্তু একী! তা করতে গিয়ে বাংলার প্রশাসনিক প্রধানকে অশালীন আক্রমণ কেন! এদিন অনুষ্ঠান শেষে আয়োজকরা কুণাল ঘোষকে পিছনের গেট দিয়ে বেরোতে বলেন। কিন্তু তা না শুনে সামনের গেট দিয়ে বেরোন কুণাল। বহু লোককে দেখা যায় তাঁকে সমর্থন জানিয়ে সেলফি তুলতে। কুণাল বলেছেন, ‘‘ভোটের মুখে এই ধরনের সভা করে সেখানে লোক ঢুকিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে গালাগালি করা। এটা সহিষ্ণুতার নিদর্শন রাখে না।’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.