লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে নানা কিসসা-কাহিনি পর্বে পর্বে সংবাদ প্রতিদিন ডট ইনে। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ‘মৃত্যুরহস্য’ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর ‘জেলযাত্রা’, জ্যোতি বসুর ‘ঐতিহাসিক ভুল’ থেকে মোদির ‘রাজধর্ম পালন’- ফিরে দেখা হারানো সময়। লিখছেন বিশ্বদীপ দে।
কুরসির সঙ্গে সঙ্গে চলে দুর্নীতির ছায়া। স্বাধীন ভারতের প্রথম সরকারের আমলেই জিপ কেলেঙ্কারির কথা আমরা জানি। এর চার দশক পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নামে ‘চোর হ্যায়’ স্লোগান উঠেছিল। যদিও তা প্রমাণিত হয়নি। তবু এই এক অভিযোগ ও স্লোগানের দ্বৈত ধাক্কায় সরকার বদলে যায়। পরবর্তী সময়ে বিজেপির আমলে কফিন কেলেঙ্কারি ইত্যাদি আরও দুর্নীতির অভিযোগে সাড়া পড়েছে। কিন্তু এই লেখায় আমরা ফিরে দেখব বোফর্স মামলাকেই। তার আগে একবার ছুঁয়ে দেখব জিপ কেলেঙ্কারি।
দেশ তখন সবে স্বাধীন। জওহরলাল নেহরুর আমল। সীমান্তে চলছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। যা প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধ নামেও পরিচিত। ৪৬০০টি জিপ প্রয়োজন ছিল ভারতীয় সেনার। এর মধ্যে ১ হাজার জিপ আমেরিকা সরবরাহ করেছিল। বাকি জিপগুলো নিয়ে চলছিস আলোচনা। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটেনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার ভি কে কৃষ্ণ মেনন ২ হাজার জিপ অর্ডার দিলেন। কিন্তু সেই জিপগুলি নতুন নয়। আর এখানেই শুরু হল বিতর্ক। কেননা একই দামে নতুন জিপই কেনা যেত আমেরিকা, কানাডা থেকে। কিন্তু মেননের যুক্তি ছিল অবিলম্বে সরবরাহ করা হবে। এবং সেটাও খুচরো যন্ত্রাংশ সমেত। যেহেতু যুদ্ধ চলছে, তাই অপেক্ষা করার কোনও উপায়ও নেই। প্রশ্ন উঠেছিল, বরাত দেওয়া সংস্থাটিকে নিয়েও। মাত্র ৬০৫ পাউন্ডের মূলধন ছিল অ্যান্টি-মিস্টান্টেস নামের সংস্থাটির। আচমকা তাদের সঙ্গেই চুক্তি করে ফেলেন মেনন। এবং কোনও যাচাই পর্ব ছাড়াই ৬৫ শতাংশ টাকা দিয়েও দেওয়া হয়। ডেলিভারি দেওয়ার সময় ২০ শতাংশ এবং তার পর একমাসের মধ্যে বাকিটা দিয়ে দেওয়া হবে বলে ঠিক হয়। কিন্তু শেষমেশ মাত্র ১৫৫টি জিপই পাওয়া গিয়েছিল। এবং তার সব কটিকেই বাতিল করে দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক! ১৯৪৯ সালের মার্চের পর সংস্থাটিও চুক্তিটি বাতিল করে দেয়।
বেকায়দায় পড়ে মেনন এবার এস সি কে এজেন্সি নামের এক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করলেন। মোট ১০০৭ জিপ। মাসে মাসে ৬৮টি। এবং আগের চুক্তির ক্ষতিপূরণও পাওয়ার কথা ছিল সরকারের। কিন্তু দেখা গেল ২ বছরে মাত্র ৪৯টি জিপই রপ্তানি করতে পেরেছে সংস্থাটি। বাকি চুক্তি তারা বাতিল করে দেয়। এর পরই মেননের বিরুদ্ধে ওঠে দুর্নীতিতে জড়িত থাকা অভিযোগ। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৮০ লক্ষ টাকার চুক্তি কেন করেছিলেন তিনি, প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। কিন্তু ১৯৫৫ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থ ও ভারত সরকার জানিয়ে দেয় বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য বন্ধ রাখা হচ্ছে তদন্ত। অথচ এর চার বছর আগেই আয়ঙ্গার সাব-কমিটি যে রিপোর্ট পেশ করেছিল তাতে পুরো বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত লেখা ছিল। পরের বছর ১৯৫৬ সালে মেনন কোনও পোর্টফোলিও ছাড়াই মন্ত্রী হন। পরে তাঁকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও করেন নেহরু। নেহরুর এই ‘বন্ধুর’ বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ যদিও প্রমাণ করা যায়নি। তবু তাঁকে টেনে নেহরুর দিকে কাদা ছোড়া বন্ধ ছিল না। কিন্তু যেহেতু সেই সময় সংবাদমাধ্যমের আজকের চেহারা ছিল না, তাই সেই অর্থে দেশব্যাপী এই নিয়ে শোরগোল পড়েনি। রাজীব গান্ধীর আমলে পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল কিংবা সোশাল মিডিয়া তখনও বহু দূরে, কিন্তু সংবাদপত্র, রেডিওর পাশাপাশি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে দূরদর্শনও উঠে এসেছে। ফলে দেশভর ছড়িয়ে পড়ে বিরোধীদের স্লোগান ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়’। ঠিক কী ছিল এই বোফর্স মামলা (Bofors scam case)?
ভারতীয় রাজনীতিতে রাজীবের উত্থান প্রায় অকস্মাৎ। বরং সঞ্জয় গান্ধীর নাম মসৃণ গতিতে উঠে আসছিল। কিন্তু প্রথমে বিমান দুর্ঘটনায় সঞ্জয়ের প্রয়াণ এবং পরে ইন্দিরা হত্যা- এই দুই ঘটনায় দেশের রাজনীতির অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন রাজীব গান্ধী (Rajiv Gandhi)। সঞ্জয়ের মৃত্যুর পরে হাত শিবিরে তিনি প্রবেশ করেন। ইন্দিরার প্রয়াণে তিনিই হন দেশের প্রধানমন্ত্রী। ‘কুরসির কিসসা’র অন্য পর্বে আমরা এই নিয়ে আলোচনা করেছি। যাই হোক, ইন্দিরার মৃত্যুর পরে হওয়া প্রথম নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪১৪ আসন। যা আজও নজির। ৪৯.১০ শতাংশ ভোটই পেয়েছিল শতাব্দীপ্রাচীন দলটি। ‘মিস্টার ক্লিন’ রাজীবের করিশ্মা তখন ভারতীয় রাজনীতির অলিন্দে ঝলমল করছে। সেটা ১৯৮৪ সাল। কে ভাবতে পেরেছিল মাত্র বছর দুই-তিনের মধ্যেই পরিস্থিতি কতটা বদলে যেতে চলেছে। ‘কমিশন’ খেয়ে ‘নিম্নমানের’ কামান কেনার অভিযোগ উঠবে তাঁদের বিরুদ্ধে।
এখানে একজনের কথা বলতেই হবে। তিনি ভি পি সিং। পুরো নাম বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের পিছনে ছিলেন সঞ্জয় গান্ধী। কিন্তু রাজীবের আমলেই তাঁকে দেওয়া হয়েছিল অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব। বড় বড় সংস্থার বিরুদ্ধে ওঠা করফাঁকির অভিযোগের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু শিগগিরি তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে দিলেন রাজীব। একান্ত বৈঠকে ভি পি সিংকে জানালেন, দেশের সীমান্তে অস্থিরতা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। তিনি এবার দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদ সামলান। বলা হয়, রাজীব বুঝতে পারছিলেন ভি পির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তাই তাঁকে সরিয়ে অন্য মন্ত্রক দেন তিনি। আবার কর্পোরেট সংস্থাগুলোও নাকি চাপ সৃষ্টি করছিল। সঠিক কারণ অবশ্যই জানা যায়নি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই বিশ্বনাথ প্রতাপই দল ছেড়ে গড়েন জনতা দল। বিজেপি ও বামেদের সহায়তায় ১৯৮৯ সালে গড়েন নতুন সরকার। তিনি হন প্রধানমন্ত্রী। সেবারের নির্বাচনের আসল ইস্যু হয়ে উঠেছিল বোফর্স মামলাই। এবার সেপ্রসঙ্গে আসা যাক।
১৯৮৬ সালের ১৮ মার্চ। ভারতের সঙ্গে ১৪৩৭ কোটি টাকার চুক্তি হয় সুইডেনের অস্ত্র নির্মাণকারী সংস্থার। সেই চুক্তি মোতাবেক চারশোটি ১৫৫ এমএম হাউইৎজার গান বা কামান কেনার পরের বছর ১৯৮৭ সালের ১৬ এপ্রিল সুইডেনের এক রেডিও চ্যানেল দাবি করে, এর জন্য ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও প্রতিরক্ষা আধিকারিকদের ‘কমিশন’ দিতে হয়েছে ওই সংস্থাকে। ১৯৯০ সালের ২২ জানুয়ারি সিবিআই এফআইআর দায়ের করে বোফর্সের প্রেসিডেন্ট বোফর্স মার্টিন আরবডো, অভিযুক্ত ‘মিডলম্যান’ উইন চাড্ডা ও হিন্দুজা ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে। ফৌজদারি ষড়যন্ত্র, প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয় তাঁদের বিরুদ্ধে। আর এই অভিযোগের কলঙ্ক পিছু নেয় রাজীবেরও।
১৯৮৯ সালের নভেম্বরে হওয়া লোকসভা নির্বাচনকে বলা হয়েছিল ‘বোফর্স ইলেকশন’। আসলে এই কেলেঙ্কারিকে হাতিয়ার বানানোর সব রকম সুযোগই নিয়েছিল বিরোধীরা। রাজীব তো বটেই, তাঁর পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের বিরুদ্ধেও আঙুল তোলা হয়েছিল। যাঁর মধ্যে ছিলেন অমিতাভ বচ্চনও। দেশজুড়ে তখন একটাই ইস্যু। ভি পি সিংয়ের জনসভায় ‘… রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়’ স্লোগানের গর্জন অনেকেরই স্মৃতিতে থাকবে।
অথচ শেষপর্যন্ত রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে কোনও দুর্নীতিই প্রমাণিত হয়নি। আর বোফর্সও যে নিম্নমানের ছিল না তার প্রমাণ মিলেছিল কার্গিল যুদ্ধে। মাত্র ১২ সেকেন্ডে ৩ রাউন্ড গোলা ছুড়তে পারে বোফর্স। আর সেটাই হয়ে ওঠে শত্রুকে ঘায়েল করে যুদ্ধজয়ের এক অন্যতম ফ্যাক্টর। ২০০৫ সালে দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতি (এখন অবসরপ্রাপ্ত) আর এস সোধি সিবিআইয়ের অভিযোগকে খারিজ করে দেন। তার আগের বছরের ফেব্রুয়ারিতেই রাজীব গান্ধীকে নির্দোষ বলে জানিয়ে দেয় আদালত। তার পরও অনেক দূর গড়িয়ে গিয়েছে জল। মাঝে মাঝেই বোফর্সকে হাতিয়ার করতে দেখা যায় বিজেপিকে। কিন্তু আজও রাজীবের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করা যায়নি। অথচ সেই অভিযোগই দেশের কুরসি পরিবর্তনের অমোঘ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছিল ১৯৮৯ সালে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.