সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ব্র্যান্ড মোদিতে চিড় ধরলেও লোকসভায় জয়ের হ্যাট্রিক করতে চলেছে এনডিএ জোট। তথাপি ভাঙল না রায়বরেলির মিথ! জয়ী হলেন রাহুল (Rahul Gandhi)। গান্ধী পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম। রেকর্ড ৩ লক্ষেরও বেশি ভোটের (Lok Sabha Election 2024 Result) ব্যবধানে হারলেন ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থী দীনেশ প্রতাপ সিং। এমনকী গণনার মাঝেই হার স্বীকার করেন তিনি। অর্থাৎ বিধানসভায় হাহাকার উঠলেও লোকসভায় যথারীতি কংগ্রেসকে স্বমহিমায় ফেরাল রায়বরেলি। নেহরু, ইন্দিরা, সোনিয়ার পর রাহুলকেও জয়ের আস্বাদে স্বাগত জানাল সাই নদীর তীরের বাসিন্দারা। এমনকী সোনিয়া গান্ধীর (দেড় লক্ষের বেশি) চেয়ে বড় ব্যাবধনে জিতলেন রাহুল। প্রশ্ন হল, বার বার কেন এমনই হয়? রায়বরেলি মানেই গ্যারান্টি কংগ্রেস! কারণ কী?
গ্যারান্টির কারণ একটাই। তিনবার ব্যাতিক্রম হলেও ১৯৫২ থেকে শুরু করে যত বার লোকসভা ভোট হয়েছে, এখানে জিতেছে হাত প্রতীকই। ২০-র মধ্যে ১৭ বারই। ইতিহাস বলছে, কংগ্রেস ছাড়া বিকল্প কাউকে ভাবেনই না রায়বরেলির ভোটাররা। ফিরোজ গান্ধী দিয়ে শুরু, সর্বশেষ ২০১৯ এর ভোটে সোনিয়া গান্ধী। ৫ বছর আগের শেষ সাধারণ নির্বাচনে গেরুয়া ঝড়ে উত্তরপ্রদেশ-সহ হিন্দি বলয়ে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায় কংগ্রেস। এমনকী উত্তরপ্রদেশে তাদের আরেক গড় আমেঠিতে স্মৃতি ইরানির কাছে হেরে যান খোদ রাহুল গান্ধী। বাকি বিরোধীদের হালও তথৈবচ। কিন্তু রায়বরেলিতে যথারীতি সেই কংগ্রেস!
১৯৫২, ১৯৫৭-য় ফিরোজ গান্ধী। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী। ইন্দিরা স্বয়ং জেতেন তিনবার। বাকি নির্বাচনগুলোতেও জয়জয়কার হয় যাঁদের, তাঁদের কোনও না কোনও যোগসূত্র আছে ওই পরিবারের সঙ্গে। ১৯৮০-র উপনির্বাচন, ১৯৮৪-তে সেখানে জয়ী হন জওহরলাল নেহরুর নাতি অরুণ নেহরু। ১৯৮৯, ১৯৯১ এ জেতেন শীলা কউল। শীলা ওই পরিবারের আত্মীয়। আরও কয়েকজন কংগ্রেস প্রার্থী হয়েছেন যাঁদের সঙ্গে গান্ধী পরিবারের যোগসূত্র আছে বা তাঁদের ঘনিষ্ঠ। প্রয়াত রাজীব গান্ধী, সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে ১৯৯৯-এ জয়ী ক্যাপ্টেন সতীশ শর্মার ঘনিষ্ঠতা সুবিদিত ছিল। মাত্র দুবার, ১৯৬২ আর ১৯৯৯এ নেহরু-গান্ধী পরিবারের কেউ প্রার্থী হননি।
একাধিপত্যের রায়বরেলিতে কংগ্রেস বিরাট ধাক্কা খায় ১৯৭৭-এর লোকসভা নির্বাচনে। জরুরি অবস্থার শ্বাসরোধকারী অধ্যায় শেষে কংগ্রেস, ইন্দিরা গান্ধী তখন আমজনতার চোখে ভিলেন। সেবার ব্যালটে সংসদীয় বিপ্লব ঘটে যায়। হেরে যায় কংগ্রেস। রায়বরেলিতে ইন্দিরাকে হারিয়ে ইন্দ্রপতন ঘটান রাজনারায়ণ। ৫৫ হাজারের বেশি ভোটে হারেন ইন্দিরা। তৎকালীন বিরোধীরা এক ছাতার নীচে জড়ো হয়ে জনতা পার্টি গঠন করেন। তাঁদেরই প্রার্থী ছিলেন রাজনারায়ণ।
এহেন রায়বরেলি সোনিয়া গান্ধীকে জিতিয়েছে টানা ৫ বার। ২০০৪, ২০০৬ (উপনির্বাচন), ২০০৯, ২০১৪, ২০১৯। ২০০৪ এ তিনি পান ৫৮.৮ শতাংশ, ২০০৬ এ তা লাফিয়ে বেড়ে হয় ৮০.৫ শতাংশ। ২০০৯ এ তা কমে হয় ৭২.২ শতাংশ। ২০১৪য় আবার বেড়ে হয় ৮৩.৮ শতাংশ। ২০১৯ এ অনেকটা কমে হয় ৫৫.৮ শতাংশ। ২০১৯ এ সোনিয়া বিজেপির দীনেশ প্রতাপ সিংকে ১, ৬৭,১৭৮ ভোটে হারিয়ে জয়ী হন। দীনেশ পান ৩৮.৩৫ শতাংশ ভোট। হেলাফেলা করার মতো নয় মোটেই। সেই দীনেশই ২০২৪ এ বিজেপির প্রার্থী হন রায়বরেলিতে। কেবল বদলে গিয়েছে কংগ্রেসের মুখ।
বয়সজনিত কারণে ভোটপ্রচারের ধকল নিতে পারবেন না বলে ভোটে না লড়ার সিদ্ধান্ত নেন সোনিয়া গান্ধী। তাছাড়া ইতিমধ্যে রাজস্থান থেকে রাজ্যসভায় গিয়েছেন বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেত্রী। এই অবস্থায় রায়বরেলির ব্যাটন তুলে দেন নতুন প্রজন্মের হাতে। প্রার্থী হন রাহুল গান্ধী। যদিও প্রশ্ন উঠছিল, ৯০ শতাংশ হিন্দু অধ্যুষিত রায়বরেলি কি নতুন প্রজন্মকে গ্রহণ করবে? যেখানে ৫টি বিধানসভা আসনে কোথাও নেই কংগ্রেস, রাম মন্দির হাওয়ায় ব্র্যান্ড মোদির ঝড় গোটা দেশে।
২০২২ এর উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটে তিনটি সমাজবাদী পার্টির, ২টি আসন বিজেপির দখলে যায়। প্রার্থীদের একজনকে আবার কংগ্রেস থেকে ঘর ভাঙিয়ে এনে টিকিট দিয়েছিল বিজেপি। অর্থাৎ কংগ্রেসের ঘরেই ভাঙন। শুধু তাই নয়, ৪টি কেন্দ্রে কংগ্রেস নেমে যায় তিন নম্বরে, ১টিতে চারে। ৫ বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস পেয়েছিল সাকুল্যে ১৩.২ শতাংশ ভোট। সমাজবাদী পার্টি ৩৭.৬, বিজেপি ২৯.৮ শতাংশ। এ থেকেই পরিষ্কার, নিজেদের গড়ে শক্তি খোয়াচ্ছে কংগ্রেস। গোটা রাজ্যে বিপর্যয়ের আঁচ থেকে রক্ষা পায়নি শক্ত ঘাঁটিও। উত্তরপ্রদেশে ২০২২ এ কংগ্রেস মাত্র ২টি আসন পায়, ভোট শতাংশ ২.৩!
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছিল, বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের শক্তিক্ষয়ের প্রতিফলন কি ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে দেখা যাবে? যখন অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির প্রতিশ্রুতি পূরণ করে হিন্দি বলয়ে ঝড় তুলেছে গেরুয়া শিবির। নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মা আগের চেয়ে আরও জোরাল হয়েছে। সর্বভারতীয় ফল অবশ্য ততটা ভালো হয়নি এনডিএ জোটের। আধিপত্য নিয়ে ক্ষমতায় ফিরছে না বিজেপি। তবে লোকসভায় হ্যাট্রিক করছেন নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে শতাব্দী প্রাচীন দলের দায় কাঁধে তুলে নিয়ে রায়বরেলির মান রাখলেন রাজীবপুত্র রাহুল। ৩ লাখ ৯০ হাজার ৩০ ভোটে প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করলেন তিনি। অক্ষত রইল কংগ্রেসের মরুদ্যান। ভাঙল না রায়বরেলি, কংগ্রেস এবং গান্ধী পরিবারের মিথ!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.