সম্প্রতি ‘আইএমএফ’ তাদের ‘আর্টিকল ফোর’-এর রিপোর্টে ভারতের অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে কয়েকটি সুপারিশ করেছে। আইএমএফের দাওয়াই মেনে কেন্দ্র নয়া শ্রমবিধি লাগু করতে সচেষ্ট হলেও শিক্ষার পরিকাঠামো উন্নত করতে কি ব্যয়বৃদ্ধি করবে? ঋণের অনুপাত কমাতে রাজস্ব বৃদ্ধির আরও উপায় কি খুঁজবে কেন্দ্রীয় সরকার? লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
‘অাইএমএফ’-এর পরামর্শ মেনে কি কেন্দ্রীয় সরকার অার্থিক সংস্কারে গতি বাড়াবে? গত কয়েক দিন ধরে সংবাদমাধ্যমে এই নিয়ে বিস্তর চর্চা শুরু হয়েছে। কারণ, সম্প্রতি, অাইএমএফের ‘অার্টিকল ফোর’-এর সমীক্ষা ও পরামর্শ সংক্রান্ত রিপোর্টটি প্রকাশে্য এসেছে। চুক্তির ‘অার্টিক্ল ফোর’ অনুযায়ী প্রতি বছর সদস্য দেশগুলিতে অাইএমএফ তাদের প্রতিনিধিকে পাঠায়। অাইএমএফের প্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট দেশে গিয়ে অর্থনীতির হালহকিকত দেখেন। অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলি নিয়ে সমীক্ষা চালান। সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। এরপর সদর দপ্তরে ফিরে এসে পরিচালক বোর্ডের সামনে রিপোর্ট দেন। কিছু দাওয়াই-সহ অাইএমএফ সেই রিপোর্ট প্রকাশ করে।
ভারতের অার্থিক সংস্কার প্রক্রিয়া গত ৪০ বছর ধরে অাইএমএফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের পরামর্শেই পরিচালিত হয়েছে। অাটের দশকের গোড়া থেকেই অাইএমএফের সুপারিশ মতো কেন্দ্র ধীরে-ধীরে অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করার কাজ শুরু করেছিল। নয়ের দশকের সূচনায় যা মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে গতি পায়। ফলে অামাদের দেশের সরকারের কাছে অাইএমএফের সুপারিশ ও পরামর্শ সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিচারেই অাইএমএফের সাম্প্রতিক ‘অার্টিকল ফোর’-এর সমীক্ষা ও রিপোর্ট গুরুত্ব পাচ্ছে।
এবারের ‘অার্টিকল ফোর’-এর রিপোর্টে অাইএমএফ ভারতের অর্থনীতি নিয়ে অাশা দেখানোর পাশাপাশি উদ্বেগও প্রকাশ করেছে। বিশেষত ভারতে বেসরকারি লগ্নি না-বাড়া এবং বাজারে যথেষ্ট চাহিদা না-থাকা অাইএমএফের কাছেও উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। ভারতীয় অর্থনীতিতে এই উদ্বেগ বেশ কিছু দিন ধরেই চলছে। কিন্তু এর সমাধানের কোনও পথ পাওয়া যাচ্ছে না। মোদি সরকার গত কয়েক বছর পরীক্ষামূলকভাবে জোগান-শৃঙ্খলাকে মসৃণ করে চাহিদা বাড়ানোর রাস্তায় হঁাটার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বর্তমান বছরের বাজেট থেকে কিছুটা বিকল্প রাস্তায় চলার চেষ্টা শুরু হয়েছে। অায়কর কমিয়ে একাংশর ক্রেতার হাতে অতিরিক্ত অর্থ তুলে দিয়ে বাজারে চাহিদা কিছুটা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এতেও কোনও ফল মিলবে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
অাইএমএফ তাদের ‘অার্টিকল ফোর’-এর পরামর্শদান রিপোর্টে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ করেছে। তাদের অন্যতম সুপারিশ হল, কোষাগার ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ছেড়ে সরকারকে নজর দিতে হবে বার্ষিক অায়ের তুলনায় ঋণের অনুপাত কমিয়ে অানার বিষয়ে। ভারত সরকারের ঋণ জাতীয় অায়ের সমান হতে চলেছে বলে এক বছর অাগে অাশঙ্কা প্রকাশ করেছিল অাইমএফ। অর্থাৎ, ঋণ ও জিডিপির অনুপাত ১০০ শতাংশ। বর্তমানে এটা ৮০ শতাংশের বেশি। জিডিপির তুলনায় সরকারের ঋণের অনুপাত না-কমলে উন্নয়ন ও পরিকাঠামোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থ মিলবে না বলে অাইএমএফেরও ধারণা। জিডিপি ও ঋণের অনুপাত নিয়ে অাইএমএফের উদ্বেগে কেন্দ্রীয় সরকার উষ্মা প্রকাশ করেছিল। বহু উন্নত দেশেরও যে মোট ঋণের পরিমাণ জাতীয় অায়কে ছাপিয়ে গিয়েছে, তা অাইএমএফকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে কেন্দ্র এবারের বাজেটে ঘোষণা করেছে ২০২৭ সালের মধে্য জিডিপি ও ঋণের অনুপাত ৫০ শতাংশে নামানোর চেষ্টা করা হবে। অাপাতভাবে যতই সমালোচনা হোক, অাইএমএফের পরামর্শের যে বাড়তি গুরুত্ব রয়েছে, তা বোঝাই যায়।
অাইএমএফের দেওয়া পরামর্শে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, শ্রমবিধি সংস্কারে। পুরনো ২৯টি শ্রম অাইনকে মিলিয়ে ২০১৯ ও ২০২০ সালে চারটি শ্রম বিধি এনেছে কেন্দ্রীয় সরকার। কোভিডের সময় সংসদে কার্যত অালোচনা ছাড়াই বিধিগুলি পাশ করিয়ে নিয়েছিল নরেন্দ্র মোদির সরকার। পরে বেঁকে বসে কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলি। শ্রম সংবিধানের যৌথ তালিকাভুক্ত রাজে্যর সায় ছাড়া কেন্দ্র এই অাইনগুলি প্রয়োগ করতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কর্নাটক ইত্যাদি বিজেপি বিরোধী সব রাজ্যই ঘোষণা করে দিয়েছে যে, কেন্দ্রের নয়া শ্রমবিধি তারা লাগু করবে না। অাইএমএফ মনে করছে ভারতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে গেলে ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’ অারও বাড়াতে হবে। মানে অারও শিল্পবান্ধব পরিবেশ দরকার। সেক্ষেত্রে জরুরি শ্রম অাইনের সংস্কার। কেন্দ্রের নয়া শ্রমবিধি লাগু করার বিষয়ে প্রকারান্তরে চাপ রয়েছে আইএমএফেরও।
ভারতীয় অর্থনীতির জন্য অাইএমএফের সবচেয়ে বড় দাওয়াই হল, কেন্দ্রীয় সরকারকে কর্মসংস্থান বাড়াতে নজর দিতে হবে। মহিলাদের কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্ধেক অাকাশকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। ভারতের শ্রমশক্তির ৪৩ শতাংশ এখনও কৃষিতে যুক্ত। এর বড় অংশকে শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে অানতে হবে। কাজের গুণগত মান না বাড়াতে পারলে বাজারে চাহিদা ও বেসরকারি লগ্নি, কোনওটাই বাড়ানো সম্ভব নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ মানুষের কর্মক্ষমতাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। কিন্তু ভারতের মোট কর্মক্ষম মানুষের খুব সামান্য অংশই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহারে সক্ষম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে সক্ষম কর্মীবাহিনী গড়তে গেলে শিক্ষার পরিকাঠামোকে উন্নত করতে হবে। শিক্ষাখাতে সরকারের খরচ বাড়াতে হবে।
অাইএমএফের দাওয়াই মেনে সরকার নয়া শ্রমবিধি লাগু করতে সচেষ্ট। কিন্তু শিক্ষার পরিকাঠামো বানাতে কি সরকার ব্যয়বৃদ্ধি করবে? ঋণের অনুপাত কমাতে কি সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির অারও উপায় খুঁজবে? এসব প্রশ্নের উত্তর এবার পাওয়ার সময় এসেছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.