কোপা ফাইনালে মাঠের বাইরে আহত লিও মেসি কাঁদলেন। এই কান্নার সঙ্গে পৌরুষেয় বিভার যোগ নেই। এই কান্না একান্ত ক্রীড়াসূচক।
ফুটবল খেলার প্রতি অনেকের অনীহার অন্যতম কারণ, এটি প্রচণ্ডরকম ‘বডি কনট্যাক্ট’ গেম। কড়া ট্যাক্ল, সংঘর্ষ, অঝোর রক্তপাত ফুটবলের অনুষঙ্গে জড়িয়ে থাকে নিবিড়। উত্তেজনার আঁচ মাঝে মাঝে এত প্রবল হয়ে ওঠে যে, তেতে ওঠে দর্শকাসন। দু’-পক্ষের সমর্থকরা জড়িয়ে পড়ে পেশিশক্তির প্রদর্শনে। জ্বলে আগুন। পুলিশের এলোপাথাড়ি লাঠি, আর্ত চিৎকার, কুকথা ও পালটা প্রতিরোধে মাঝে মাঝে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে গ্যালারি। মাঠেও ফুটবলারদের লক্ষ্য করে উড়ে যায় জলের বোতল, পচা ডিম, জুতো, আরও কত কিছুই না!
ফুটবলের মতো হকি বা ক্রিকেটও সমবেত খেলা। কিন্তু হিংসার তুলনা করলে ফুটবল এগিয়ে থাকবে কয়েক যোজন। ক্রিকেট যে ‘অভিজাত’ ও ‘ভদ্রলোক’-এর খেলা বলে পরিচিতি পেয়েছে তার অন্যতম কারণ অবশ্যই এই যে, ক্রিকেট মাঠে হিংসা কখনওই আগুনের হলকার মতো ছড়িয়ে পড়ে না। কথার মারপ্যাঁচ চলতে থাকে, অপশব্দও প্রযুক্ত হয়, কিন্তু মারমুখী মেজাজে ক্রিকেটাররা পরস্পরের দিকে ধেয়ে যাচ্ছেন– এমন অল্পই ঘটে। ঘটলে, ম্যাচ রেফারির তরফে সতর্কতা ও ফাইন ইত্যাদি করা হয়। এমন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ফুটবল মাঠেও আছে। কিন্তু তা যেন যথেষ্ট নয় আক্রামক ফুটবলারদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।
অর্থাৎ, ফুটবলে পেলবতা কম, নমনীয়তা কম, শান্তরসের অভাব প্রকট। সেজন্য ফুটবলকে ‘পুরুষালি খেলা’ বলে অনেকেই ধরে নেয়। কিন্তু নিয়তির কী বিধান– পুরুষপ্রধান এই খেলার কুশীলবেরা প্রায়শই কেঁদে আকুল হন! ‘মর্দ কো দর্দ নহি হোতা’– এই বুলি বা রটনার কোনও স্থান নেই ফুটবলের পরিসরে। পরাজিত হয়ে, জয়ের দোরগোড়া থেকে ফিরে এসে, স্বপ্নকে খান-খান হয়ে ভেঙে যেতে দেখে হাপুস নয়নে কেঁদেছেন তাবড় সব ফুটবলার।
পল গায়কোয়েন থেকে জন টেরি, ‘ব্যাড বয়’ মারিও বালোতেলি থেকে জিয়ানলুইগি বুফো, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো থেকে লুই সুয়ারেজ– কে কাঁদেননি! এই তালিকায় থাকবে লিও মেসির নামও। তাঁরা প্রত্যেকে মহাতারকা। নিজের দিনে ক্লাবের সেরা, দেশেরও সেরা। পৌরুষে, গ্ল্যামারে, দুষ্টুমির রৌনকে এঁরা টেনে নিতে জানেন মিডিয়ার সব আকর্ষণ।
কিন্তু এরপরেও তাঁদের কান্নার সঙ্গে পৌরুষেয় বিভার সম্পর্ক না-পাতিয়ে, আমরা দেখতে চাইব তাঁদের খেলার মাঠের ব্যাকরণের সঙ্গে মিলিয়ে। খেলার মাঠ রক্ত-ঘাম-পরিশ্রমের ত্রিবেণীসঙ্গম। নিরলস অধ্যবসায় ও আত্মত্যাগ লিখে রাখার অলিখিত খাতা। এখানে শর্টকাট চলে না। এখানে ফাঁক ও ফাঁকির জন্য পুরস্কার নেই। তাই একজন ফুটবলার যখন কান্নায় ভেঙে পড়ে, মনে রাখতে হবে, তিনি আসলে সব হারানোর বেদনায় আচ্ছন্ন। এর সঙ্গে পৌরুষেয় দাপটের সম্পর্ক নেই, বাজার অর্থনীতির হযবরল যোগ নেই, রয়েছে একনিষ্ঠ সাধনার ফল আঁকড়ে ধরতে না-পারার অপার শূন্যতা। এখানেই মেসি ও রোনাল্ডো এক পঙ্ক্তির সন্তান।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.