Advertisement
Advertisement

Breaking News

Dragon Tattoo

ড্রাগন বেঁচে আছে মানুষের মনে, তাই ট্যাটুতেও জয়জয়কার

শাসক থেকে অপরাধী– ড্রাগনের বাসা সবার শরীরেই।

Dragon tattoos are popular all over the world
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:January 2, 2025 4:07 pm
  • Updated:January 2, 2025 4:07 pm  

সারা পৃথিবীতে জাপানি ট্যাটুর জয়জয়কার এখন, যার অন্যতম প্রধান উপজীব্য এই ড্রাগন। ‘ড্রাগন ট্যাটু’-র আসল কৌশল হল, এর কম্পোজিশন। শরীরের খাঁজ-কাটা আঁশের মতো অজস্র প্যাটার্ন, ড্রাগনের গায়ের মোটা-মোটা রোম, ভয়ংকর মুখের ক্রুর সাংঘাতিক চোখ, বিশাল হঁা-মুখ, মুখের চারপাশে তীক্ষ্ণ ছুরির মতো প্রচুর গোঁফদাড়ি, শিঙের মতো কান– এসব ছড়িয়ে দিতে হয় ক্যানভাসের মতো মানুষের শরীরে। লিখলেন ঋত্বিক মল্লিক

ভবিষ্যতের রাজা পঞ্চম জর্জ এলেন জাপানে, সময়টা ১৮৮২ সাল। জাপানে ঘুরতে-ঘুরতে দেখা হল হোরি চিও-র সঙ্গে। শুনলেন এই হোরি চিও একজন অত্যন্ত দক্ষ শিল্পী, তবে তঁার সৃষ্টি কোনও কাগজ বা ক্যানভাসে ফুটে ওঠে না, এর যাবতীয় রূপ পায় মানুষের ত্বকে। এই শিল্পীর হাতে পঞ্চম জর্জ তুলে দিলেন নিজের বাহু, একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা, সামান্য রক্ত, কালো রঙের টান– কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে ফুটে উঠল একটি ড্রাগনের ছবি।

Advertisement

অথচ রাজার হাতে এই ধরনের ট্যাটু থাকার কথা তখন ভাবা-ই যেত না। যাদের হাতে দেখা যেত, তারা ছিল এক-একজন ভয়ংকর অপরাধী, ইয়াকুজা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। জুয়া, নিষিদ্ধ ড্রাগ কেনাবেচা, নারী পাচার, স্মাগলিং থেকে খুনখারাপি– সবরকমের সঙ্গে জড়িত ছিল এই সংগঠনটি। ইয়াকুজা গোষ্ঠীর সদস্যরা পালন করত সামুরাইদের মতো আচার-অনুষ্ঠান, আর এদের সারা শরীর ভরে থাকত কারুকার্যময় ড্রাগনের ট্যাটুতে। ধীরে-ধীরে শাসক থেকে অপরাধী– ড্রাগন বাসা বঁাধল সবার শরীরেই।

তবে ‘ড্রাগন’ বলে সত্যি কোনও প্রাণী এই পৃথিবীতে কোনও দিন ছিল বলে তো মনে হয় না। এমন কোনও পাথুরে প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। যে-প্রাণীর সঙ্গে ড্রাগনের সবচেয়ে বেশি মিল, তার নাম টেরোসোর, সাড়ে ছ’-কোটি বছর আগে লুপ্ত হয়ে যাওয়া এই প্রাণীটি ছিল মূলত সরীসৃপ, কিন্তু ডানা থাকায় উড়তেও পারত। এই উড়ন্ত সরীসৃপের বংশধর ছিল রোপেন। বলা হয় যে, পাপুয়া নিউগিনির কোথাও-কোথাও কদাচিৎ একে নাকি দেখা যেত। এই তথ্যটিও কিন্তু একেবারেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। বরং কোনও কোনও ইন্দোনেশীয় দ্বীপে মনিটর লিজার্ড বংশের এক বিরাট টিকটিকির মতো সরীসৃপের দেখা মেলে, তাকে অনেকে চিহ্নিত করে ‘কোমোডো ড্রাগন’ বলে, আর তাকেই মনে করা হয়– ড্রাগনের একমাত্র ‘জীবিত আত্মীয়’।
বহু-বহু বছর ধরে ড্রাগন শুধু বেঁচে আছে মানুষের মনের মধ্যে, কল্পনার মধ্যে। সারা পৃথিবীর নানা পুরাকথায় এদের উপস্থিতি– ব্যাবিলনের টিয়ামত দেবী থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার বুনিপ উপজাতি, কিংবা উত্তর আমেরিকার পিয়াসা, অ্যাজটেকের কুইৎজালকোটল দেবতা বা পশ্চিম আফ্রিকার আইডো হোয়েডোর মধ্যে এখনও রয়ে গিয়েছে ড্রাগন। গ্রিক উপকথাতেও সে শুধু আছে তা-ই নয়, ‘ড্রাগন’ শব্দটির মূলেই রয়েছে গ্রিক শব্দ ‘ড্রাকোন’, যার অর্থ ‘বিরাট সরীসৃপ’। এই কথাও প্রচলিত যে, চিন দেশের রাজারা এসেছেন আসলে এই ড্রাগনের থেকেই। তাই ড্রাগনকে তঁারা মনে করেন দৈবী শক্তির অধিকারী এবং তঁাদের রাজবংশের
প্রতীক হিসাবেও ড্রাগনকে স্থান দেন।

তবে এরও আগে, পূজিত হতেন নু-কুয়া নামের এক দেবী, যঁাকে দেখতে ছিল অর্ধেক নারী আর অর্ধেক ড্রাগনের মতো। তবে এই প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, ‘পাশ্চাত্য’ ড্রাগন আর ‘প্রাচ্য’ ড্রাগনের মধ্যে আছে অনেক ফারাক। প্রাচ্য ড্রাগন কিন্তু ইতিবাচক শক্তির প্রতীক, হিতসাধনকারী আর যাবতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণের উপায়। অন্যদিকে, পাশ্চাত্যের ড্রাগন অশুভ আর ক্ষতিকর। প্রাচীন মিশরে সূর্যদেবতা রা-র সঙ্গে নাকি সর্বক্ষণ লড়াই চলে ড্রাগন দেবতা অ্যাপোফিস-এর। অ্যাপোফিস হলেন বিশৃঙ্খলা আর অন্ধকারের দেবতা। প্রতিদিন এই লড়াইয়ে একবার সূর্য জেতেন, আর-একবার যেতেন ড্রাগন-রূপী অন্ধকার। শুভ হোক বা অশুভ, ট্যাটু হিসাবে জনপ্রিয়তম এই ‘মোটিফ’ জায়গা করে নিয়েছেন মানুষের শরীরে।
মানুষের শরীরকে যদি ক্যানভাস ভাবেন, তাহলে মোটামুটি তিনরকমের আকার আপনি পাবেন ট্যাটু করার জন্য। পিঠ বা বুকের মতো প্রায় সমতল, হাত বা পায়ের মতো চোঙাকার, তল আর নিতম্বের মতো অর্ধগোলাকার তল। সাধারণভাবে হাতে বা পায়ে সাপের মতো জড়িয়ে থাকে ড্রাগন। আবার কখনও লম্বালম্বিভাবে থাকে পুরো হাত বা পা জুড়ে। প্রচুর কারুকাজের অবকাশ থাকে পিঠের ক্ষেত্রে। সুঠাম চেহারার কোনও মানুষের পিঠের অনেকখানি ছড়ানো স্পেসকে কাজে লাগিয়ে কুণ্ডলী পাকানো একাধিক ড্রাগনের শরীর সেখানে থাকতে পারে। আবার কখনও সেই কুণ্ডলীর একটা বা দুটো ফঁাস নেমে আসতে পারে নিতম্বের ওপরেও। মুখোমুখি আক্রমণকারী দু’টি ড্রাগনের ভয়ংকর মুখ নাটকীয়ভাবে অঁাকা হয় নিতম্বের দু’টি অংশে, আর শরীর দুটো ছড়িয়ে থাকে সারা পিঠে। তবে ‘ড্রাগন ট্যাটু’-র আসল কৌশল হল, এর কম্পোজিশন। শরীরের খঁাজ-কাটা অঁাশের মতো অজস্র প্যাটার্ন, ড্রাগনের গায়ের মোটা-মোটা রোম, ভয়ংকর মুখের ক্রুর সাংঘাতিক চোখ, বিশাল হঁা-মুখ, মুখের চারপাশে তীক্ষ্ণ ছুরির মতো প্রচুর গোঁফদাড়ি, শিঙের মতো কান– এসব ছড়িয়ে দিতে হয় ক্যানভাসের মতো মানুষের শরীরে। ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকে কখনও কালো রং বা অন্য কোনও গাঢ় রং। ড্রাগনের মূল শরীর অঁাকা হয় সাধারণত সবুজ বা নীলে, মুখের ভিতর আর জিভ হয় টকটকে লাল। গায়ের রোম আগুনের মতো হলুদ। এই ভয়ংকর চেহারার মধ্যেই হয়তো ফুটে থাকে লাল টুকটুকে গোলাপ বা বহু পাপড়ির পদ্ম। নীল আকাশ বা বৃষ্টির জল ভরা কালো ঘন মেঘ আর সঙ্গে সবুজ লতাপাতা, তার মধ্যে ফুটে থাকা অজস্র ছোট-ছোট ফুল হামেশাই থাকে ড্রাগনের শরীরের ফঁাকে ফঁাকে। এর ফলে তৈরি হয় রঙের অপরূপ বৈচিত্র। একের-পর-এক খুবই সূক্ষ্ম অঁাচড়ে ফুটে উঠতে থাকে এসব ছবি। শরীরের কোন ভঁাজে কেমন হবে কম্পোজিশন– ট্যাটুর সার্থকতা নির্ভর করে তার ওপরেই।

জাপানে ড্রাগনের সঙ্গে থাকে মাইও দেবতার ছবি। ভয়ংকর ক্ষিপ্ত মুখমণ্ডল, হাতের ত্রিশূলে জড়ানো ড্রাগন আর চারপাশে জ্বলছে আগুনের লেলিহান শিখা। সেই আগুনে যেন পরিশুদ্ধ হচ্ছে চারপাশ। কোমরের ভঁাজকে ব্যবহার করা হয়েছে দেবতার আসন হিসেবে। এক পা ভঁাজ করে রাখা আছে নিতম্বের ঠিক উপরে। অন্য পা নেমে এসেছে থাইয়ের উপর। জাপানে চারটি প্রাণীকে ‘পবিত্র’ বলে মনে করা হয়– নীল রঙের ড্রাগন, ফিনিক্স, সাদা বাঘ এবং কালো কচ্ছপ। এরা কম্পাসের প্রধান চারটি দিকের প্রতিনিধি। প্রত্যেকটির সঙ্গে রয়েছে ঋতু আর নির্দিষ্ট রঙের অনুষঙ্গ। জাপানি ট্যাটুর ক্ষেত্রে তাই ড্রাগনের সঙ্গে সঙ্গে জায়গা পায় এই প্রাণীরাও। এখন সারা বিশ্বে জনপ্রিয় ড্রাগন ট্যাটুগুলি মূলত এই জাপানি ট্যাটুরই বিভিন্ন সংস্করণ। চিনের ট্যাটু কিন্তু অনেকটাই আবদ্ধ হয়ে আছে চিনের মধ্যেই। তাই স্বাভাবিক ভাবেই চৈনিক শিল্পীরাও সেইভাবে ছড়িয়ে পড়েননি অন্যান্য দেশে।

তবে সারা পৃথিবীতে যতই জাপানি ট্যাটুর জয়জয়কার হোক, জাপানি শিল্পীদের একচ্ছত্র অধিকার কিন্তু একেবারেই নেই ট্যাটু অঁাকার ক্ষেত্রে। বরং ট্যাটু-শিল্পী হিসাবে হাত পাকিয়েছেন বিভিন্ন দেশের মানুষ। যেমন ধরুন, মাদ্রিদের রিকার্ডো দে লা ভিগা। তঁার করা একটি অসাধারণ ট্যাটুর কথা এখানে উল্লেখ করি।

একজন লোকের পিঠের ডান দিক জুড়ে রয়েছে আক্রমণকারী এক ড্রাগনের ভয়ংকর মুখভঙ্গি, আর নীচের দিকে তিন আঙুলের একটি থাবা। সে আক্রমণ করছে একটা লাল টুকটুকে মাছকে। এই কাজটি করা হয়েছে শ্বেতাঙ্গ এক পুরুষের পিঠে। ত্বকের নিজস্ব রং ছাড়া রিকার্ডো ব্যবহার করেছেন শুধু কালো আর লাল রং, আর তাতেই তৈরি হয়েছে রেখা আর রঙের অপূর্ব হারমনি। আবার ধরুন, সুইডেনের জোহান সিনের করা একটি কাজ, যেটি কঁাধ থেকে নেমে এসেছে কনুই পর্যন্ত। অন্যান্য ড্রাগন ট্যাটুর ভয়ংকর আবহ এখানে নেই– বরং শান্ত এক সৌন্দর্যের আভাস ফুটে উঠেছে সেখানে। এই আভাসটি আরও জোরালো হয়ে ওঠে যখন জোহান সিন প্রার্থনারত এক নারীকে রাখেন ছবির একেবারে কেন্দ্রে।
ইংল্যান্ডের শিল্পী সিন উড অবশ্য শুধু ছবিই অঁাকেন না, ছবির নীচে লিখে দেন, ‘LIFE IS PAIN’। শরীরে ট্যাটু করা যন্ত্রণার বিষয় ঠিকই, কিন্তু যন্ত্রণা তো নানাভাবে ছড়িয়ে আছে সারা জীবনেই। তাই ট্যাটুর যন্ত্রণার সঙ্গে তিনি মিলিয়ে দিতে চান জীবনকে। চিন দেশের প্রচলিত একটি প্রবাদ হল, ‘Crouching Tiger, Hidden Dragon’। প্রবাদটির লক্ষ্য হল সেসব শিল্পী, যঁারা খুবই প্রতিভাবান, কিন্তু সেই প্রতিভা লুকিয়ে রাখতে জানেন সাধারণ লোকচক্ষুর থেকে আড়ালে। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবী জুড়ে এমন অনেক ট্যাটু শিল্পী আছেন, যঁারা হয়তো তঁাদের শিল্পকর্মের জন্য সেভাবে কদর পান না, তবুও গোপনে কাজ করে যান, লুকিয়ে রাখেন নিজেকে। এমনকী, এমন প্রচুর ট্যাটু-শিল্পীর নাম পাওয়া যায়, যেগুলি হয়তো তঁাদের ‘আসল নাম’-ই নয়। শরীরকে ক্যানভাস মনে করে কাজ করে যাওয়া এই শিল্পীরাই হলেন আসল– ‘Hidden Dragon’.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement