Advertisement
Advertisement

Breaking News

National Wealth

এক্স-রে রিপোর্ট

ট্রেনের টয়লেটে স্টিলের মগটিকে পর্যন্ত শিকলে বেঁধে রাখতে হয়, এই লজ্জা কি প্রত্যেকের নয়?

Are we not responsible for the maintenance of 'national wealth'
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:June 21, 2024 2:13 pm
  • Updated:June 21, 2024 2:13 pm

‘জাতীয় সম্পদ’ গড়ে তোলার দায় যদি ক্ষমতাসীন সরকারের উপর বর্তায়, তবে রক্ষণাবেক্ষণের দায় কি অন্তত খানিকটা এসে পড়ে না আমাদের কাঁধেও, যারা সেই সম্পদের নিয়মিত উপভোক্তা? প্রতি বছর ভারতীয় রেলের যাত্রীরা গড়ে ২ লাখ তোয়ালে, ৮১ হাজার বিছানার চাদর, এবং ৭ হাজার কম্বল চুরি করে– ভাবা যায়? লিখলেন স্বাগতম দাস

ভোটের মরশুম চলে গেল। চ্যানেলে চ্যানেলে ‘সার্কাস’ বসিয়ে সকাল-সন্ধ্যায় পছন্দমতো নেতা-নেত্রীদের কাটাছেঁড়া করে, এ দল-ও দল মিলে রাজতন্ত্রের তালে তালে মাদল বাজানোও হল অনেক। এবার, নিজেদের দিকেও একটু তাকিয়ে দেখি। দেশ বা সরকার আমাদের কী দিয়েছে, এ-বিষয়ে রায় দেওয়ার পাশাপাশি আমরা দেশকে কী দিয়েছি, এটাও ভাবি দু’দণ্ড।

Advertisement

ঠিকই যে, আমাদের ঘর-সংসার চালাতে হয়, তাই দেশ চালানোর জন্য আমরা সরকারকে নির্বাচিত করি। কিন্তু তাতেই কি সব কর্তব্য শেষ হয় যায়? নিজেদের ও আগামী প্রজন্মের মধ্যে সহ-নাগরিকত্বের মূল্যবোধ জাগানোর, আর জাতীয় সম্পদসমূহকে যত্নে রাখার দায় কি আর বর্তায় না আমাদের উপর? শুধুমাত্র কাগজে-কলমে ‘নাগরিক’ হলেই কি ষোলোকলা পূর্ণ, না কি ‘প্রকৃত’ নাগরিকত্ব একটা আজীবনের অনুশীলনও বটে– নিজের চারপাশটাকে ভাল রাখার অনুশীলন, নিজেদের নাগরিক মূল্যবোধকে বঁাচিয়ে রাখার নিরন্তর প্রয়াস? ভোট দিয়ে ১৭টি লোকসভা গঠন করে আসার পর, এই করোনা-উত্তর ভারতে দঁাড়িয়ে, এসব চিন্তাবিন্দুকে প্রাণিত রাখাটা বোধহয় খুব জরুরি। নইলে এরকমই চলবে– শতাব্দী বা রাজধানীর এসি টু-টায়ার কামরা থেকে হাতসাফাই করে আনা ধপধপে বেডশিটের উপর জমিয়ে বসে টিভিতে কোনও স্থানীয় নেতার ত্রিপল বা চালচুরির সাতকাহন দেখতে দেখতে টিকাটিপ্পনি চালিয়ে যাব আমরা– যারা ঠিকঠাক সুযোগের অভাবে বড়ই ‘সৎ’!

[আরও পড়ুন: হলং বাংলোয় শর্ট সার্কিট কীভাবে? নেপথ্যে উঠে আসছে ইঁদুরের গল্প!]

ভাবতে অবাক লাগে, প্রাচীনতম ধর্মের গর্ব করা যে-দেশে ঠাকুর-দেবতা নিয়ে এত কথা, এত চর্চা, মন্দির-মসজিদ নিয়ে এত রাজনীতি, সেই দেশের দিনগত চর্যায় ঈশ্বরকে কোন স্তরে টেনে নামিয়ে এনেছি আমরা? আক্ষরিক অর্থেই তাই দোকান বা বাড়ির দেওয়ালে বিরাট-বিরাট করে অঁাকা দেব-দেবীর চিত্রের সঙ্গে এ-কথাও লেখাও থাকে– জলমোচন করবেন না। শুধু নির্দেশ বা অনুরোধটি লেখা থাকলে তো কেউ মানবে না, ঠাকুরের ছবি থাকলে, পাপের ভয়ে যদি কেউ সংযত হয়! কলকাতার উত্তর প্রান্তের যে-অঞ্চলে থাকি, সেখানে অভিজাত আবাসনের উল্টোদিকে লেকের ধারে সুন্দর পার্ক সাজিয়ে আমজনতার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে যুগের হাওয়া অনুযায়ী আলোকিত রোমান হরফে বিরাট করে লেখা হয়েছিল– ‘আই লাভ বারানাগার’। ক্রমে কাচ ভেঙে একটি-একটি করে বর্ণের আলো চুরি হতে হতে, পুরো বাক্যটি প্রথমে পরিণত হল ছাপার অযোগ্য শব্দাংশে। রাতের কুটুমদের ধন্যবাদ, সম্প্রতি, সেই শেষ হরফ দু’টিও আলো-সহ চুরি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

এ তো গেল রাস্তার খবর! স্থানীয় ভাষায় এসব চুরি ‘পাতাখোরদের কাজ’। শহরের তলপেটে বাস করা কিছু নিম্নবুদ্ধির মানুষের থেকে ‘সিভিক সেন্স’ প্রত্যাশা করা হয়তো ঠিক নয়। কিন্তু কী আশ্চর্য, উলটো দিকের অভিজাত আবাসনটিতেও তো হরদম চোখে পড়ছে তথাকথিত শিক্ষিত উচ্চ-মধ্যবিত্ত মানুষের অ-নাগরিক আচরণ। সেখানে কেউ সাধারণের ব্যবহারের প্যাসেজ গায়ের জোরে দখল করে রেখে দিচ্ছে সাইকেল থেকে ঢাউস ক্যাবিনেট, কেউ ছাদের সুদৃশ্য স্কাই-ওয়াকে পছন্দমতো দড়ি খাটিয়ে কাপড় শুকোচ্ছে, আবার কেউ হয়তো নিজের ফ্ল্যাটের যাবতীয় আবর্জনা নিত্য জড়ো করে অব্যবহার্য করে তুলছে সিঁড়ির ধাপগুলোকে। শহরের প্রায় সব আবাসনের
অবিরল এই উদাহরণে উঠে আসে তাদের কথা, যারা পরোয়া করে না অন্য সহ-নাগরিকদের সুবিধা-অসুবিধার। যেমন পরোয়া করে না সেই মা– যে নিউটাউনের ইকো পার্কের পরিপাটি সাজানো গোলাপ ঝাড় থেকে নির্দ্বিধায় পটাপট ফুল ছিঁড়তে থাকে শুধু মেয়ের চুলে পরিয়ে ছবি তুলবে বলে। পরোয়া করে না সেসব যাত্রী– যারা সহযাত্রীদের দীর্ঘ লাইন ও এয়ার হস্টেসদের বিনম্র আর্তি সত্ত্বেও বিমানের পুরো আইল জুড়ে রেখে নিজেদের বসার জায়গা অদলবদল করে, বা সরু ব্যস্ত রাস্তার একপাশ জুড়ে মোটরবাইক দঁাড় করিয়ে ঢুকে পড়ে কোনও দোকানে, আর সেই বাইকের কল্যাণে ক্রমে দীর্ঘায়িত হয়ে একটি শ্বাসরোধী যানজট।

[আরও পড়ুন: জয় দিয়ে কোপা শুরু বিশ্বজয়ীদের, মেসির নজির গড়া ম্যাচে কানাডাকে হারাল আর্জেন্টিনা]

‘জাতীয় সম্পদ’ গড়ে তোলার দায় যদি ক্ষমতাসীন সরকারের উপর বর্তায়, তবে তার রক্ষণাবেক্ষণের দায় কি অন্তত খানিকটা এসে পড়ে না আমাদের কঁাধেও, যারা সেই সম্পদের নিয়মিত উপভোক্তা? কী করে ভারতীয় রেলের মাথায় কলঙ্কতিলকের মতো জ্বলজ্বল করে বাৎসরিক চুরির এক ভয়াবহ পরিসংখ্যান যে– প্রতি বছর রেলের যাত্রীরা গড়ে ২ লাখ তোয়ালে, ৮১ হাজার বিছানার চাদর ও ৭ হাজার কম্বল চুরি করে? পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি হিসাবে উঠে আসতে চাওয়া এই দেশের যাত্রীবাহী ট্রেনের টয়লেটে স্টিলের মগটিকে পর্যন্ত শিকলে বেঁধে রাখতে হয়– এই লজ্জা কি আমাদের প্রত্যেকের নয়? সাধারণের ব্যবহার্যে নির্মিত সুলভ শৌচালয়ের যে বেহাল ও নোংরা অবস্থা আমাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে, তার জন্য পুরসভা বা সরকারের পাশাপাশি আমাদের দায়ও কিছু কম নয়!

এর বিপ্রতীপে সমাজ-মাধ্যমে একদা বহুলপঠিত জাপানের একটি গল্প আরও একবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক। ভারতের এক ব্যবসায়ী একবার জাপানের রেলপথে চলেছেন টোকিও থেকে নাগোয়া। তঁার কুপের উলটো দিকের আসনটিতে মাঝপথ থেকে সওয়ার হলেন আরেকজন জাপানি সহযাত্রী। প্রৌঢ় ভদ্রলোক সম্ভ্রান্তদর্শন। কিছুক্ষণ ম্যাগাজিন পড়ার পরে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে জাপানি ভদ্রলোকটি সঙ্গের সুটকেস হাতড়ে বের করলেন মোটা সুতো আর সুচ। তারপর তিনি আসনের একদিকের ফেটে যাওয়া গদির কাপড়টি নিপুণ হাতে সেলাই করতে লাগলেন। আমাদের ভারতীয় ব্যবসায়ীটি এতক্ষণ চোখ ছানাবড়া করে এই কাণ্ড দেখছিলেন, এবার আর কৌতূহল সামলাতে
না-পেরে যেটুকু জানতেন, সেই জাপানি ভাষায় সহযাত্রীকে প্রশ্ন করলেন– ‘আপনি কি এই রেলের কর্মচারী?’ প্রৌঢ় স্মিত হেসে বললেন, ‘না।’ ভারতীয় ভদ্রলোক বললেন, ‘এতক্ষণ বসার সিটের গদি সেলাই করলেন যে!’ এবার জাপানি ভদ্রলোক আরেকটু হেসে উত্তর দিলেন, ‘এ আর এমন কী ব্যাপার? কোম্পানির কাজের জন্য যাচ্ছি, নিজের কাপড়ের বড় ব্যবসা আছে। তা, চোখে পড়ল বসার সিটের কাপড়টা ছিঁড়ে গিয়েছে। হাতে সময় ছিল, আর ঘটনাচক্রে কিছুটা সুতো আর সুচও ছিল। তাই ভাবলাম সেলাই করে ফেলি, ট্রেনটা তো দেশের সঙ্গে সঙ্গে আমার-ও!’

‘জাতির পিতা’-র অন্যান্য গুণ আসুক বা না-আসুক, আইন অমান্যের ব্যাপারটা তির্যক বিভঙ্গে একেবারে আমাদের অন্তর্গত রক্তে মিশে গিয়েছে। তাই শহরের যে কোনও দিকে চোখ ফেরালেই দেখতে পাই– মানুষ বর্ণিল থুতু ফেলছে পথে বা দেওয়ালে, কেউ রাস্তার সঠিক দিক দিয়ে হঁাটছে না, কোনও কাউন্টারের সামনে তৈরি হচ্ছে না একটিমাত্র সুশৃঙ্খল মানবশ্রেণি, ট্রাফিক সিগনালে বাইক এবং সাইকেল আরোহীরা ফুটপাতের উপর দিয়েও এ-ওর আগে চলে যাওয়ার প্রতিযোগিতা থামাচ্ছে না। আমরা ভারতীয়রা ব্যক্তিগতভাবে খুব পরিষ্কার। আমরা নিয়মিত দঁাত ব্রাশ করি, প্রতিদিন স্নান করি, খাওয়ার আগে হাত ধুই। আমরা ঘর-বারান্দা পরিষ্কার রাখি, কিন্তু যখন সাধারণের ব্যবহার্য স্থানের কথা আসে, তখন আমরা আমাদের রাস্তা, আমাদের রেলওয়ে স্টেশন কিংবা হাসপাতাল ও উপাসনালয়কে পর্যাপ্ত পরিষ্কার রাখতে অক্ষম।

নাগরিক সচেতনতা বা ‘সিভিক সেন্স’ আসলে আমাদের সামাজিক নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার একটি বোধ। প্রচলিত বিদ্যালয় স্তরের শিক্ষার মাধ্যমে সর্বস্তরের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই বোধ যে আদৌ গড়ে ওঠে না– সেটা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। এই বোধ বহুলাংশে সঞ্চারিত হয় সমাজের অনেক অলিখিত নিয়মকানুনের প্রতি মানুষের বিবেচনা থেকে। অনেকে মনে করে– ‘নাগরিক সচেতনতা’ শুধু রাস্তাঘাট, পথঘাট বা জনসাধারণের সম্পত্তি পরিষ্কার রাখার সঙ্গে সম্পর্কিত। আসলে, ‘নাগরিক সচেতনতা’ এর চেয়েও বেশি কিছু– যা আসে আইনের মর্যাদা এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সহ-মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমমর্মিতা থেকে। এই বোধ কার্যকর না হলে আমরা নাগরিকত্বের শত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় হয়ে উঠতে পারব না। জাতি হিসাবেও পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাব না– এমনকী, প্রশাসনের শীর্ষবিন্দুতে ‘ঈশ্বর-প্রেরিত’ আসীন হলেও।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক কলকাতা আইএসআইয়ের অধ্যাপক

২০২৪ এর পূজা সংক্রান্ত সমস্ত খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের দেবীপক্ষ -এর পাতায়।

চোখ রাখুন
Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement