Advertisement
Advertisement

Breaking News

Jamshedji Tata

বাণিজ্যের পুরনো কিসসা, টাটা কাহিনি

এই গল্পে জড়িয়ে রয়েছে জামশেদজি টাটা-র নাম।

A business Story of Jamshedji Tata
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:March 4, 2025 6:49 pm
  • Updated:March 4, 2025 6:49 pm  

ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতির প্রভাবে ভারতের বাণিজ্য কত দূর প্রভাবিত হবে, এই জল্পনার মাঝে পুরনো কিস্‌সা ভেসে ওঠে। ‘আমেরিকার গৃহযুদ্ধ’-র সুবাদে ব্রিটেনের বাজারে ভারতের তুলোর সাময়িকভাবে খুব কদর হয়েছিল, কিন্তু পরে সেই জোয়ার কেটে যায় ও ব্যবসা এমন মার খায় যে, নাসেরবানজি টাটাকে মুম্বইয়ের সাত তলা বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। এই গল্পে জড়িয়ে রয়েছে জামশেদজি টাটা-র নাম। সোমবার ছিল তাঁর জন্মদিন। লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।

নতুন করে ক্ষমতায় আসা ডোনাল্ড ট্রাম্পের কার্যকলাপ দেখে দুশ্চিন্তা দানা বাঁধছে। ভারত বিশ্বায়নের সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে পারবে– তা নিয়েও দেখা দিচ্ছে প্রশ্ন। ফলে, ঘরোয়া অর্থনীতির দিকে নজর ঘুরছে আর্থিক-বৃদ্ধির নিমিত্তে। তবে ভারতের বাণিজ্যে মার্কিন প্রভাব তো নতুন কিছু নয়। পিছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, দেড়শো কি পৌনে দুশো বছর আগে, মার্কিন মুলুকে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ কেমন সাংঘাতিক প্রভাব ফেলেছিল ভারতের বাণিজ্য-অর্থনীতিতে। পৌষ মাস পরিণত হয়েছিল সর্বনাশে। যার ফলে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন ভারতীয় শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ জামশেদজি টাটা (১৮৩৯-১৯০৪)।
তাঁর প্রথম জীবনের এই কাহিনিতে আর-একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেন প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ। অনেকেই হয়তো ‘প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলার’ কথাটার সঙ্গে পরিচিত।

Advertisement

এই বৃত্তি সেই প্রেমচাঁদ রায়চাঁদের নামেই। ১৮৬৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের শিক্ষার অগ্রগতির জন্য সহৃদয় বিত্তবানদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ দু’-লক্ষ টাকা দান করেছিলেন। এছাড়া, সে-যুগে তিনি প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা দান করেছিলেন নানা জনহিতকর কাজে। এই প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ হলেন উনবিংশ শতাব্দীর ‘Cotton King’, তাঁকে বম্বের ‘original share king’-ও বলা হয়ে থাকে। নিজগুণে সেই সময়কার কয়েকজন ভারতীয় শেয়ার দালালের অন্যতম মুখ ওঠেন তিনি। শেয়ার বাজারের পাশাপাশি তুলো ব্যবসায় হয়ে ওঠেন দক্ষ।

প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ ছিলেন জামশেদজির বাবা নাসেরবানজি-র চেয়ে বয়সে ছোট, কিন্তু জামশেদজির চেয়ে বড়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নাসেরবানজি এবং প্রেমচাঁদ দু’জনেরই বোম্বাইয়ে রমরমা ব্যবসা ছিল। তাঁরা নজর দেন চিনে তুলো ও আফিম রপ্তানি, এবং চিন থেকে সিল্ক, কর্পূর, চা, তামা, সোনা আমদানি করার দিকে। সেই উদ্দেশ্যে ফার ইস্টে শাখা সংস্থা গড়ে ওঠে। এর অংশীদার নাসেরবানজির পাশপাশি কল্যাণদাস, প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ প্রমুখ। এ-ই ফার ইস্টের ব্যবসা সামলাতে যুবক জামশেদজিকে পাঠানো হয় হংকং এবং সাংহাইতে।
এদিকে, ওই সময় ‘দাস প্রথা’ ঘিরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে উত্তরাঞ্চল আর দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে ক্রমশ বিরোধ বাড়ছিল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় সে-বিরোধ চরমে পৌঁছয়। সেই পরিস্থিতিতে ১৮৬১ সালের ৪ মার্চ আব্রাহাম লিঙ্কন রাষ্ট্রপতি রূপে শপথ নেন। কয়েক দিন পর ১২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের অধীনস্থ ফোর্ট সামটার দুর্গে দক্ষিণের সেনাবাহিনী আক্রমণ করলে শুরু হয় ‘আমেরিকার গৃহযুদ্ধ’ (১৮৬১-’৬৫)।

মার্কিন গৃহযুদ্ধের জেরে ব্রিটেনের শিল্প ধাক্কা খায় কঁাচামালের জোগানে। আমেরিকার বদলে তুলোর ‘বিকল্প’ উৎস খুঁজতে বিভিন্ন উপনিবেশের দিকে নজর দেয় ব্রিটিশরা। নজরে আসে ভারতের তুলো। মার্কিন ‌গৃহযুদ্ধের কারণে ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ারের মিলে কাঁচামালের অভাব মেটাতে বম্বের কাছে রফতানির সুবর্ণ সুযোগ আসে। বম্বের পশ্চিমাঞ্চল থেকে তুলোর চাহিদা উল্কাগতিতে বৃদ্ধি পায়। ল্যাঙ্কাশায়ারের মিলে ওই সময় ভারতীয় তুলো রপ্তানিকারীদের বাজারের যা দাম, তার অনেক বেশি দিতে হত। প্রথমে এ-দেশের বহু লোকের মনে আশঙ্কা ছিল, তুলোর এই চাহিদা সাময়িক– কারণ আমেরিকার গৃহযুদ্ধ কিছু দিনের মধ্যে থেমে যাবে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে ‘গৃহযুদ্ধ’ চলতে দেখে সেই ধারণা বদলে যায়, এ-দেশের তুলোর চাহিদা সম্পর্কে ভিন্ন ও ইতিবাচক আত্মবিশ্বাস জন্মাতে থাকে অনেকের মনে।

এবং তখনই ব্যবসা দেখাশোনার জন্য জামশেদজিকে ফার ইস্ট থেকে সরিয়ে ইংল্যান্ডে পাঠানোর কথা ভাবা হয়। নাসেরবানজি এ পরিকল্পনা করেন তঁার অন্য অংশীদারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে। কিন্তু অভিজ্ঞতা কম থাকলেও জামশেদজি তখন ব্যবসায় তঁার বয়োজ্যেষ্ঠদের বোঝাতে চেয়েছিলেন, এই তুলো রফতানির রমরমা বেশি দিন থাকবে না। কারণ গৃহযুদ্ধের শেষার্ধে লিঙ্কন আইনত আমেরিকায় ‘দাস প্রথার অবলুপ্তি’ (১৮ ডিসেম্বর, ১৮৬৫) ঘোষণা করে দিয়েছেন। সে খবর ক্রমশ ক্রীতদাস শিবিরে মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকায় গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছিল। কিন্তু নাসেরবানজি সেদিন যুবক জামশেদজির কথায় তেমনভাবে কান দিতে চাননি। বরং প্রেমচাঁদ রায়চাঁদজি যা খবর সংগ্রহ করেছিলেন তাতে তাঁর ধারণা হয়েছিল, অত তাড়াতাড়ি ‘গৃহযুদ্ধ’ থামবে না। আরও কিছু দিন এই তুলা রফতানির রমরমার সুবিধা ভোগ করা যাবে।

ফলে পরিকল্পনামাফিক জামশেদজি জাহাজে উঠলেন। কটন এজেন্সি খোলার উদ্দেশ্য নিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি দিলেন। সঙ্গে নিলেন কটন মার্কেটের সিকিউরিটিজ এবং ‘বিল অফ এক্সচেঞ্জ’। কিন্তু ইতিমধ্যে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ থিতিয়ে যেতে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে থাকল সে-দেশ। এত দিন ধরে স্তব্ধ থাকা ব্রিটিশ-মার্কিন বাণিজ্যপথের জটও খুলে গেল। আমেরিকার তুলো আবার ইউরোপের বন্দরে ঢুকতে থাকায় ভারত থেকে তুলো রফতানির বাজারে ধস নামল। সাময়িক বিকল্প হিসাবে ভারতের তুলো গ্রহণ করলেও ওই মিলগুলির
পছন্দ ছিল আমেরিকার তুলো-ই। এবং ভারতে তুলা-ব্যবসা ঘিরে নেমে এল হাহাকার। বোম্বাইয়ে ব্যবসায়ীরা এতটাই মার খেয়েছিলেন যে, বেশ কয়েকজন তুলো ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করেন। এই আর্থিক বিপর্যয়ের জন্য অভিযোগের আঙুল ওঠে প্রেমচঁাদ রায়চঁাদের ভূমিকার দিকে৷

জামশেদজির জাহাজ ব্রিটিশ রাজধানীতে যখন পৌঁছয়, বলা বাহুল্য, তখন তঁাদের ব্যবসায় গণেশ উল্টানো দশা। যুবক জামশেদজি বুঝতে পারলেন, তঁার সঙ্গে থাকা সিকিউরিটির স্ক্রিপ্ট রাতারাতি মূল্যহীন কাগজে পরিণত হয়েছে। তিনি হয়েছেন নিঃস্ব। তবু সেই কঠিন সময় হতাশ না-হয়ে বরং পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টায় নামলেন। সব কথা জানিয়ে ‘ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড’ এবং ‘রয়্যাল এক্সচেঞ্জ’-এর কাছে‌ দরবার করলেন। আলোচনা করার জন্য সময় চাইলেন।‌ ২৫-২৬ বছরের ওই ভারতীয় যুবকের কথায় আস্থা রেখে তঁাকেই ‘লিকুইডেটর’-এর ভার দেওয়া হল প্রতি মাসে ২০ পাউন্ডের বিনিময়ে।

অন্যদিকে, তুলোর বাজারের ধস নামায় পাওনাদারদের দেনা মেটাতে গিয়ে নাসেরবানজি বোম্বাইতে তঁার সাধের সাত তলা বাড়িটি বেঁচে দিতে বাধ্য হন।‌ প্রায় বছর চারেক বাইরে থাকার পর দেশে ফেরেন জামশেদজি। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন অবশ্য জামশেদজির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল দাদাভাই নওরোজি এবং ফিরোজ শাহ মেহতার। এই দুই বন্ধুর প্রভাবেই জামশেদজির মনে স্বদেশিয়ানার বীজ বপন হয়েছিল। স্থির করেন, দেশে ফিরে এবার আর বাবার তত্ত্বাবধানে নয়– নিজেই স্বাধীনভাবে ব্যবসায়ে নামবেন। নজর দিলেন মিল খোলার প্রতি। তারপরে ধীরে ধীরে গড়ে তুললেন টাটা সাম্রাজ্য।

সাম্প্রতিক সময়ে ভূ-রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা যেভাবে বাড়ছে, তা দেখে সেদিনের আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ঘটনা প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। একদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন করে ক্ষমতায় এসে কী-কী নীতি নেবেন, কোন দেশের উপরে শুল্ক চাপাবেন, তা নিয়ে জল্পনা চলছে; অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের যুদ্ধ কোন দিকে গড়াবে, সে নিয়েও সংশয় কমছে না। এই পরিস্থিতিতে বিদেশে বাণিজ্য করতে পারলে নিশ্চয় ভাল, কিন্তু বাস্তবে তা কত দূর সম্ভব? গত ছ’-মাসে সেনসেক্স এবং নিফটি যথাক্রমে ৯% এবং ১০% নেমেছে।

এটাকে নিছক বাজারের সংশোধন বলে বিশ্লেষণ করা কি আদৌ ঠিক হবে? এই পতনের একটি প্রধান কারণ– মার্কিন বাজারে বিনিয়োগের প্রবাহ এবং বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ক্রমাগত শেয়ার বিক্রির হিড়িক। চিনের শেয়ার বাজার ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ফিরছে, যার ফলে ভারতীয় শেয়ার বাজার তুলনামূলকভাবে কম আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ভুললে চলবে না– সেদিন নাসেরবানজি, প্রেমচঁাদ রায়চঁাদরা মার্কিন গৃহযুদ্ধের অবসানের অঁাচ পাননি বলেই কিন্তু বাণিজ্যে এত বড় মাশুল গুনতে হয়েছিল তঁাদের।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
sidmukh12@gmail.com

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement
News Hub