ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে সাপের বিষ কতটা প্রাণঘাতী, তা বোঝা যায়। সাপ কামড়ালে চিকিৎসার জন্য তামিলনাড়ু বা কেরলে তৈরি অ্যান্টি-ভেনম সিরাম (এভিএস) দেওয়াই শ্রেয়। একেবারে হাতেকলমে প্রমাণিত সত্য। এমনটাই বলছেন চিকিৎসকরা।
ঘটনা ১: সাপে কামড়ানোর একঘণ্টার মাথায় শুরু হয়েছিল চিকিৎসা। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ভাঙড়ের ওই শিশুকে আনার পর চিকিৎসকরা ভেবেছিলেন, ১০ ভায়াল এভিএস দেওয়াই যথেষ্ট। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে দেখা গেল, ২০ ভায়াল এভিএস প্রয়োগ করেও লাভ হল না। প্রাণ বাঁচলেও বিকল হয়ে গেল প্রাথমিক পড়া শিশুর কিডনি।
ঘটনা ২: মধ্যবয়সী এক সর্পদষ্ট মহিলার ক্ষেত্রেও একই রকম অভিজ্ঞতা ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালের চিকিৎসকদের। আন্তর্জাতিক প্রোটোকল মেনে ১২-২০ ভায়ালেই ওই প্রৌঢ়ার বিপন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি সামলাতে বাস্তবে ৩৪ ভায়াল এভিএস প্রয়োগ করতে বাধ্য হন চিকিৎসকরা। তার পরেও স্নায়বিক সমস্যা পুরোপুরি এড়াতে পারেননি মহিলা।
গত বছর নিউটাউনেও দু’টি প্রাণহানি স্মৃতি তো এখনও দগদগে। এ ছবি আজকাল দেখা যাচ্ছে বহু হাসপাতালেই। চিকিৎসকরা অসহায় হয়ে বলছেন, যথাসময়ে এভিএস প্রয়োগ করেও সাপে কাটা রোগীকে প্রায়শয়ই বাঁচানো যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে এড়ানো যাচ্ছে না অঙ্গহানি। কেননা, প্রত্যাশিত কাজ হচ্ছে না সাপে কাটার প্রচলিত ওষুধ অ্যান্টি-ভেনম সিরামে। চিকিৎসকরা মনে করছেন, ভিন রাজ্যের (তামিলনাড়ু) সাপের বিষ থেকে এভিএসগুলি তৈরি হচ্ছে বলেই অন্য অনেক রাজ্যের মতো তা পশ্চিমবঙ্গের সাপের বিষকেও মোকাবিলা করে উঠতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে বাংলার নিজস্ব এভিএস তৈরির দাবি তুলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিল একাধিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান।
এদের মধ্যে অন্যতম হলো ‘অ্যাভয়েডবল ডেথ নেটওয়ার্ক’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাদের রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর স্নেহেন্দু কোনার জানাচ্ছেন, মূলত তামিলনাড়ুর মহাবলীপুরম ও সংলগ্ন জেলার সাপ থেকে যে বিষ সংগ্রহ করা হয়, সেটিই এ দেশে এভিএস তৈরির ক্ষেত্রে কাজে লাগায় পুনে, মুম্বই, হায়দরাবাদ ও কসৌলির ল্যাবগুলো। এভিএস প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিও ওই ল্যাবগুলির তৈরি অ্যান্টিবডি কাজে লাগিয়ে অ্যান্টি-ভেনম সিরাম উৎপাদন করে। ‘‘অথচ পূর্ব ভারতের, বিশেষ করে বাংলায় সাপের বিষের মধ্যে থাকা প্রোটিন দক্ষিণ ভারতের ওই একই সাপের বিষের প্রোটিনের থেকে গঠনগত ভাবে অনেকটাই আলাদা। ফলে প্রচলিত এভিএস বাংলার সর্পদষ্ট রোগীদের শরীরে পুরোপুরি কাজ করছে না।’’ মন্তব্য স্নেহেন্দুর।
রাজ্যের স্নেকবাইট ট্রেনিং কর্মসূচির প্রধান চিকিৎসক দয়ালবন্ধু মজুমদার জানাচ্ছেন, এর ফলে যে রোগীর ১০ ভায়ালে কাজ হয়ে যাওয়ার কথা, তাকে ৩০ ভায়াল দিয়েও লাভ হচ্ছে না অনেক সময়ে। তাই পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের ‘সীতাপুর নবীন মানুয়া সৃষ্টি ফাউন্ডেশন’ এবং দাসপুরেরই গোমকপোতা গুণধর বিদ্যামন্দির নামের একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের সব শিক্ষকও একই দাবি নিয়ে চিঠি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীকে। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুব্রত বুরাই বলেন, ‘‘আমাদের জেলায় যা সাপের উপদ্রব, তাতে বাংলার নিজস্ব এভিএস না থাকলে বহু প্রাণহানি এড়ানো যাচ্ছে না।’’
এদিকে স্বাস্থ্যভবন সূত্রের খবর, সব ঠিক থাকলে হয়তো এ রাজ্যেই আগামী দিনে এভিএস তৈরি করবে কলকাতার কেন্দ্রীয় সংস্থা বেঙ্গল কেমিক্যাল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা কবে বাস্তাবায়িত হবে, এখনই বলা মুশকিল। এর আগে স্থানীয় সাপের বিষ সংগ্রহের জন্য বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজে স্নেক ভেনম কালেকশন সেন্টার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেই প্রকল্প এখন বিশ বাঁও জলে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.