Advertisement
Advertisement
PM Modi

‘অযোধ্যা পাহাড়ে সীতাকুণ্ডে পদধূলি পড়েছিল রামের’, মোদির বক্তব্যের বিরোধিতায় আদিবাসীরা

গেরুয়া ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের দাবি আদিবাসীদের।

Lok Sabha 2024: Locals of Purulia PM Modi's remark on Lord Rama visit in Ayodhya Hills
Published by: Sayani Sen
  • Posted:May 19, 2024 7:50 pm
  • Updated:May 20, 2024 6:13 pm  

সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: জঙ্গলমহলে ভোটের প্রাক্কালে ফের রাম-সীতার আবেগ উসকে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (PM Modi)। তাও আবার পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়কে নিয়ে। রবিবার পুরুলিয়ার (Purulia) গেঙাড়া ময়দানে নির্বাচনী জনসভা করতে এসে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ” এখানে অযোধ্যা পাহাড় আছে। অযোধ্যা পাহাড়ের বিশেষত্ব আছে। এখানে সীতাকুণ্ড আছে। প্রভু রামের পদধূলি এখানে পড়েছিল।” প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরেই নির্বাচনের প্রাক্কালে আবার অযোধ্যা পাহাড়ের সীতাকুণ্ডকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হল। আর এই বিতর্কে এবার ঢুকে পড়ল রাজনীতিও। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করল আদিবাসী সমাজ।

ওই সীতাকুণ্ড আদিবাসী মানুষজনের কাছে গড়ধামের ভুড়ভুড়ি ডাডি। আদিবাসী মানুষজনের কাছে যুগ যুগ ধরে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চিহ্নিত এবং মান্য। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অযোধ্যা পাহাড়ের যে এলাকাকে সীতাকুণ্ড বলছেন। তা রাজ্যের পঞ্চায়েত গ্রাম উন্নয়ন বিভাগের আওতায় থাকা সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ তাদের পর্যটন প্রচারপত্রে অটোফ্লো স্পেশালি ফর স্টুডেন্ট অফ অ্যান্ট্রোপলজি বলে প্রচার করে থাকে। সম্প্রতি এই এলাকায় হনুমান চল্লিশার পাঠ আয়োজন করেছিল একটি হিন্দু গোষ্ঠী বলে অভিযোগ। তারপরেই জঙ্গলমহলের বৃহৎ আদিবাসী সংগঠন ভারত জাকাত মাঝি পরগনা মহল জানিয়েছে, যে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন শুরু হয়েছে তাতে শুধু তাদের ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করবে তা নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রেও অত্যন্ত বিপদজনক। এই মর্মে পুরুলিয়ার জেলাশাসক রজত নন্দার কাছে আদিবাসীদের ওই সামাজিক সংগঠন প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের দাবি রেখে অভিযোগ জানিয়েছেন।

Advertisement
Sitakund
পুরুলিয়ার সীতাকুণ্ডকে গেরুয়াকরণের অভিযোগ

উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় নির্মীয়মান মন্দিরের উদ্বোধন ও রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠায় রাম-সীতা আবেগে এখানে দিনভর অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু এদিন প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর কল্পকাহিনী, লোককথাতেই সীমাবদ্ধ থাকা বাংলার এই অযোধ্যাকে ঘিরে যেন আরও নতুন করে জন্ম নিল ধর্মীয় আবেগ। কিন্তু কল্পকাহিনী, কিংবদন্তিকে ইতিহাসের উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা কি ঠিক? এই প্রশ্ন তুলেছে শাসক দল তৃণমূল। তৃণমূলের পুরুলিয়া কেন্দ্রের নির্বাচন পরিচালন কমিটির চেয়ারম্যান তথা পুরুলিয়া জেলা তৃণমূলের অন্যতম সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বহুদিন ধরেই লোকমুখে শোনা যায় অযোধ্যা পাহাড়ে নাকি এখনও সীতার চুল পাওয়া যায়। এসবই কল্পকাহিনী, কিংবদন্তি। একে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ব্যবহার একেবারে ঠিক নয়। জঙ্গলমহলে ভোটের আগে রাম-সীতা আবেগ উসকে দিতে চেয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। যাকে সীতাকুণ্ড বলা হচ্ছে সেই এলাকা আদিবাসীদের ধর্মীয় স্থান। শুধুমাত্র ভোট পাওয়ার জন্য এমন মন্তব্য করা ঠিক নয়। আদিবাসী মানুষজন এর জবাব দেবেন।”

[আরও পড়ুন: সব পথ মিশছে বিজেপিতে, কী করবেন বহরমপুরের ‘রবিনহুড’ অধীর?]

রাম-সীতার ১৪ বছর বনবাসে পুরুলিয়ার অযোধ্যাতেও পা রেখেছিলেন তাঁরা। এই জনশ্রুতি বহুদিনের। কেউ বলেন আড়াই দিন। আবার কেউ বলেন ২৭ দিন। অযোধ্যা হিলটপের গড়ধামের পাশে কূপ বা কুণ্ডের মতো ছোট জলাধার রয়েছে। সেটাই দীর্ঘদিন ধরে সীতাকুণ্ড নামে পরিচিত। আর এই লোককথাকে নিয়ে অযোধ্যার আরও পর্যটনের প্রসারে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে তৎকালীন পর্যটনমন্ত্রী প্রহ্লাদ সিং প্যাটেলকে পুরুলিয়ার সাংসদ তথা রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো চিঠি লেখেন।

হিন্দিতে দেওয়া সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ” অযোধ্যা পর্যটকস্থল ঐতিহাসিক ইস কারণ সে হে কি ভগবান শ্রীরাম জী , অপনে বনবাস কে দৌরান ইহা পর আয়ে থে তথা মাতা সীতাজি কি জব পিয়াস লগি থি শ্রীরাম জী নে অপনে বানসে ধরতি মে মারা অউর পানি নিকলা তথা মাতা সীতানে আপনি পিয়াস বুঝাই। উও স্থান আজ ভি অযোধ্যা হিল পর মজুদ হে জো সীতাকুন্ড কে নাম সে জানা জাতা হ্যায়।” অর্থাৎ রাম-সীতা বনবাসে থাকার সময় এই পাহাড়ে এসেছিলেন। সেই সময় সীতা দেবীর জল পিপাসা পাওয়ায় ওই অযোধ্যার ভূমে তির নিক্ষেপ করে জল বার করা হয়। সেই জল পান করেন সীতা দেবী। তাই পাহাড়ের একটি এলাকার নাম সীতাকুণ্ড।”

Jakat

আদিবাসী লোকসংস্কৃতি গবেষক তথা শিক্ষক জলধর কর্মকার বলেন, “হিমালয় যখন সৃষ্টি হয়নি তখন এখানে যাযাবরের মতো বিরহোড় জনজাতি ঘুরে বেড়াতো। তারপর ভূমিজ ও সাঁওতালরা এখানে আসেন। তাই এই ভূমি আদিবাসীদের। তারা সবাই মূর্তি পূজার বিরোধী। তাই এই পাহাড়ে রাম-সীতার গল্পের সঙ্গে প্রাচীন জনজাতির সংস্কৃতির কোন মিল নেই। তাই সাঁওতালি ভাষায় অযোধ্যা পাহাড়কে ‘আয়োদিয়া’ বলে। যার অর্থ অযোধ্যা মা সবাইকে অতিথিশালার মত এই পাহাড়ে আশ্রয় দিয়েছেন। অযোধ্যা সিং বলে এখানে একজন ভূমিজ জমিদার ছিলেন। যাঁর নামকরণে অযোধ্যা হয় বলে কথিত আছে।” পুরুলিয়া শহরের রামায়ণ পাঠকরা বলেন, তুলসীদাসের ‘রামচরিত মানস’-এ কোথাও পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের উল্লেখ নেই। এমনকি বাল্মিকির রামায়ণের সুন্দরকান্ডেও এই অযোধ্যার কথা কোথাও পাওয়া যায়নি।

Sitakund
নির্বাচনের প্রাক্কালে অযোধ্যা পাহাড়ের সীতাকুণ্ডকে নিয়ে বিতর্ক

ভারত জাকাত মাঝি পরগনা মহল জানিয়েছে, অযোধ্যা পাহাড়ের আর্টেজীয়কূপ ভূড়ভূড়ী ডাডিতে হনুমান চল্লিশার পাঠ আয়োজন করেছিলো একটি হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী। যে ভুড়ভুড়ী ডাডি আদিবাসী মানুষের কাছে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জায়গা হিসাবে চিহ্নিত এবং মান্য। যা সুতানতান্ডী ও গড়ধাম-এর অবিচ্ছেদ্য অংশ।এই সুতানতান্ডীতেই ল বীর বাইসি পরিচালিত হয়। যেখানে ভিন রাজ্য থেকেও সেন্দরা-র সময় হাজার হাজার সাঁওতাল মানুষ তাদের পরম্পরা অনুযায়ী এই সুতানতান্ডীতে জমায়েত করেন। বহমান জলধারার এই আর্টেজীয় কূপটি প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতির পুজো করা আদিবাসী সমাজ জীবন ধারণকারী এই জলধারাকে আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্যে দেখে। কিন্তু তারপরও কেন এই জলধারার পাশে হনুমান চল্লিশা পাঠ হল?
এমনকি শুধু হনুমান চল্লিশা পাঠ নয় আদিবাসীদের এই সাংস্কৃতিক স্থানের নামকে পরিবর্তন করে কেন সীতাকুণ্ড নামকরণ করার ঘৃণ্য চেষ্টা করা হচ্ছে? স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সীতাকুণ্ড বলছেন।

ওই সংগঠনের জুওয়ান মহলের জেলা সভাপতি রাজেন টুডু বলেন, “আমরা দেখেছি বর্তমানে আমাদের দেশের কেন্দ্র সরকারে ক্ষমতাসীন পার্টি দেশের একাংশ মানুষের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে সংখ্যালঘু ধর্মালম্বী মানুষের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চিহ্ন গুলিকে দখল করার চেষ্টা অতীতে চালিয়ে গিয়েছে এবং আজও যাচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আমাদের ধর্মীয় স্থানকে সীতাকুণ্ড বলছেন। এর আমরা তীব্র বিরোধিতা করছি। ভিন্ন ধর্মের এই বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নির্দশনের ওপর হিন্দুত্বের একমুখী আক্রমণকে শুধু নিন্দা নয় একে প্রতিরোধ করা আজ আশু কর্তব্য হয়ে পড়েছে। ঐতিহাসিক ভাবেই আমরা দেখেছি আদিবাসী সমাজ ধর্ম ও সংস্কৃতি গত ভাবে কখনোই কোন সম্প্রদায়ের ওপর আধিপত্য বিস্তারের কথা বলেনি বা সেই রকম কোন কাজ করে নি। আধিপত্যবাদ আমাদের সংস্কৃতিতে বর্জনীয়। ভুড়ভুড়ী ডাডিকে কেন্দ্র করে আদিবাসী সমাজের ওপর যে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের নির্দশন রাখছে হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি তা কুরুচিকর। এর যোগ্য জবাব দেওয়া হবে।”

[আরও পড়ুন: ইজরায়েলে বিস্ফোরক পাঠাচ্ছে ভারত! অস্ত্র বোঝাই জাহাজ আটকাল নয়াদিল্লির বন্ধু]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement