সুরজিৎ দেব, ডায়মন্ড হারবার: ‘নদীর ধারে বাস, দুঃখ বারোমাস।’ এই উপমা যথার্থ দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর (Mathurapur) লোকসভা কেন্দ্রের জন্য। এই কেন্দ্রের অধিকাংশ এলাকা জল-জঙ্গলে ঘেরা। সাগর ও পাথরপ্রতিমা – এই দুটি বিধানসভা এলাকার বেশিরভাগই নদীনালা বেষ্টিত। এখানে গ্রামাঞ্চলের ভোটারই সিংহভাগ, ৯৪ শতাংশ। আর শহর এলাকায় মাত্র ৬ শতাংশ ভোটার। সংখ্যালঘু ভোটারের সংখ্যা ২৪.১ শতাংশ। সত্তর দশকের লাল দুর্গ মথুরাপুর এখন পুরোটাই ঘাসফুলে ঢাকা। বর্ষীয়ান চৌধুরী মোহন জাটুয়ার কেন্দ্রে এবার তৃণমূলের বাজি যুব নেতা বাপি হালদার। বিরোধীরা এখনও প্রার্থী দেয়নি। সম্ভাব্য নাম নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে। আসুন দেখে নেওয়া যাক, চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে (Lok Sabha Election 2024) মথুরাপুর কেন্দ্রের লড়াই কেমন হতে পারে।
জনবিন্যাস
মথুরাপুর (সংরক্ষিত) লোকসভা কেন্দ্রের গ্রামীণ এলাকার ভোটার প্রায় ৯৪% এবং শহর এলাকার ভোটার প্রায় ৬%। লোকসভা কেন্দ্রে শিক্ষিতের হার ৬৭.৭৭ শতাংশ এবং ২০১১-এর জনগণনা অনুযায়ী, এই কেন্দ্রে তফসিলি জাতির ভোটার প্রায় ২৯%। তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ের ভোটারের সংখ্যা ০.৫ শতাংশ। এই কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোটার প্রায় ২৪.১ শতাংশ।
অর্থনৈতিক চিত্র
এই লোকসভা আসনের অন্তর্গত বহু এলাকা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এখনও অনুন্নত। বর্ষা এবং ভরা কোটালের সময় জোয়ারে অস্থায়ী নদীবাঁধ ভেঙে বা উপচে কৃষিজমি, পুকুর, মাটির ঘরবাড়িতে নদীর নোনাজল ঢুকে পড়ায় প্রায়ই অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের শিকার হন গ্রামের মানুষজন। স্থায়ী কংক্রিটের নদীবাঁধের আশ্বাসই ভরসা গ্রামগঞ্জের খেটে খাওয়া মানুষজনের। মূলত: পান ও সবজি এবং মাছচাষ, সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়াই পেশা এই লোকসভার বেশিরভাগ মানুষের। তবে অনেকেই এখন বেশি রোজগারের আশায় পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। লোকসভা কেন্দ্রের অধীন বকখালি, ফ্রেজারগঞ্জ, মৌসুনী, গঙ্গাসাগর পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের কাছে কাছে সুপরিচিত হলেও এলাকার মানুষের মানোন্নয়ন আজও থমকে রয়েছে।
বিধানসভা কেন্দ্র
যে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্রটি গঠিত সেগুলি –
১) পাথরপ্রতিমা
২) কাকদ্বীপ
৩) সাগর
৪) কুলপি
৫) রায়দিঘি
৬) মন্দিরবাজার (সংরক্ষিত)
৭) মগরাহাট (পশ্চিম)
এই সাত বিধানসভাই বর্তমানে শাসকদল তৃণমূলের দখলে। সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল –
তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ৫০.৭%
বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ৩৬.৪%
বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোট ৩%
কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট ১.৫%
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফল
তৃণমূল ৫২.১%
বিজেপি ৩৭.৫%
সিপিএম ৬.৬%
কংগ্রেস ২.৩%
২০১৪-এর তুলনায় ২০১৯-এ মথুরাপুর কেন্দ্রে তৃণমূল প্রায় ১০% ভোট বেশি পেয়েছিল।
রাজনৈতিক ইতিহাস
১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত মথুরাপুর কেন্দ্র ছিল সিপিএমের (CPM) দখলে। ১৯৮৪ সাল মথুরাপুর কেন্দ্র থেকে সাংসদ হন কংগ্রেসের মনোরঞ্জন হালদার। এর পর ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এই কেন্দ্রে সিপিএমের রাধিকারঞ্জন প্রামাণিক পাঁচবার সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালের ভোটে সিপিএমের বাসুদেব বর্মন সাংসদ নির্বাচিত হন। এর পর ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেসের চৌধুরী মোহন জাটুয়া তিনবারের জন্য সাংসদ নির্বাচিত হন।
২০২৪ লোকসভা ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস মথুরাপুর কেন্দ্রে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে অনেক আগেই। এখান থেকে শাসক শিবিরের সৈনিক দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ তথা তৃণমূলের সুন্দরবন সাংগঠনিক জেলার যুব সভাপতি বাপি হালদার। এখনও পর্যন্ত এই কেন্দ্রে বিরোধিরা তাদের প্রার্থী ঘোষণা করতে পারেনি। এই কেন্দ্রে তাই এখনই প্রচারে অনেক কদম এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।
তবে মথুরাপুর সাংগঠনিক জেলা বিজেপির অন্দরমহলে প্রার্থী হিসেবে দু’টি নাম শোনা যাচ্ছে। তাঁরা হলেন, রায়দিঘি বিধানসভা এলাকার একসময়ের দাপুটে তৃণমূল নেতা, পরবর্তীতে দলবদলকারী, বর্তমানে মথুরাপুর সাংগঠনিক জেলার বিজেপি নেতা পলাশ রানা এবং অন্যজন শ্যামাপ্রসাদ হালদার। এই শ্যামাপ্রসাদ হালদার ২০১৯ লোকসভা ভোটে মথুরাপুর কেন্দ্রেই বিজেপির প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়ে তৃণমূল প্রার্থী চৌধুরী মোহন জাটুয়ার কাছে ২ লক্ষ ৩ হাজার ৯৭৪ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। সেবার এই কেন্দ্রে সিপিএম পায় ৯২ হাজার ৪১৭ টি ভোট।
২০০৯ ও ২০১৪ এর লোকসভা ভোটে যদিও তৃণমূলের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সিপিএম। ২০১৪ সালে সিপিএমকে ১ লক্ষ ৩৮ হাজার ৭৬৮ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছিলেন তৃণমূল প্রার্থী চৌধুরী মোহন জাটুয়া। মথুরাপুর সাংগঠনিক জেলায় বিভিন্ন সময়ে বিজেপির দলীয় কোন্দল প্রকাশ্যে এসেছে। দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব এখনও চরমে। এই অবস্থায় দলীয় কোন্দল মিটিয়ে প্রার্থী মনোনয়নে এই লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি নেতা ও কর্মীরা কতটা একমত হবেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
এদিকে আইএসএফের প্রার্থী নিয়ে দলের মধ্যেই দ্বিমত ছিল। আইএসএফ প্রার্থী হিসেবে এই কেন্দ্রে যে দু’জনের নাম শোনা গিয়েছিল। তাঁরা হলেন উত্তর ২৪ পরগনার মধ্যমগ্রামের বাসিন্দা দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ মাইতি এবং জয়নগরের বাসিন্দা দলের জেলা ও রাজ্য কমিটির সদস্য মেঘনাদ হালদার। তবে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত আইএসএফের তালিকা অনুযায়ী, মথুরাপুর কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হলেন অধ্যাপক অজয়কুমার দাস। তিনি উত্তর দিনাজপুরের বাসিন্দা, বর্তমানে থাকেন ডানকুনিতে। বিদ্যাসাগর কলেজে দর্শনের (Philosophy) অধ্যাপক।
এই কেন্দ্রে আইএসএফ বা কংগ্রেসের সঙ্গে এখনও বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের জোটে জট রয়েই গিয়েছে। মথুরাপুর কেন্দ্রে ওই তিন দল জোটবদ্ধ হয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করবে নাকি প্রত্যেকেই আলাদা প্রার্থী দেবে, সে ব্যাপারে সন্দিহান সব পক্ষই।
সিপিএম জানিয়েছে, জোট না হলে তারা আলাদা প্রার্থী দেবে। জেলা কংগ্রেসের কথায় এখনো জোট নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে জোট যদি না হয় তাহলে জেলা কংগ্রেস প্রদেশ নেতৃত্বের কাছে মথুরাপুর কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী দাঁড় করানোর দাবি জানাবে। বিরোধীরা যখন প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি তখন শাসক তৃণমূলের প্রার্থী কিন্তু দাপিয়ে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন সুন্দরবন এলাকার দ্বীপবেষ্টিত প্রত্যন্ত এলাকায় এলাকায়। একদিকে বিজেপির ঘরোয়া কোন্দল অন্যদিকে টিমটিম করে জ্বলা সিপিএম-কংগ্রেস-আইএসএফের জোটে জট। রাজনৈতিক মহল মনে করছে ভোট ময়দানে এমনিতেই পাল্লা ভারী তৃণমূলকে বিরোধী অনৈক্য ভোটপর্বের প্রথম ধাপে অবশ্যই অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.