বিশ্বদীপ দে: বর্তমান অনেক সময়ই ইতিহাসকে জাগিয়ে তোলে। সেই ইতিহাস, যা চাপা পড়ে রয়েছে বিস্মৃতির আড়ালে। এই ঘোর করোনা কালেও প্যালেস্তাইনের সঙ্গে ইজরায়েলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সারা পৃথিবীর উদ্বেগ ও চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছিল বিগত কয়েক সপ্তাহে। আপাতত যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হলেও আলোচনায় রয়ে গিয়েছে নামগুলি। উঠে আসছে পুরনো সময়, হারানো ইতিহাসের নানা বাঁকের কথা। এভাবেই ইজরায়েলের (Israel) ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক মানুষও ফিরে আসছেন আলোচনায়, যাঁকে জিনিয়াস বললেও হয়তো কম বলা হবে। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন (Albert Einstein)। ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব তিনি না ফেরালে ইতিহাসে লেখা থাকত নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর জীবনের এক অন্য অধ্যায়। হয়তো কিংবদন্তির চরিত্রের আরও অন্য কোনও দিক ঝিকিয়ে উঠত জীবনের শেষবেলায়।
কিন্তু কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি এক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার এমন এক মহার্ঘ্য প্রস্তাব? সেই উত্তর দেওয়ার আগে একটু প্রেক্ষাপটটা বোঝা যাক। আচমকাই কিন্তু তাঁকে এমন প্রস্তাব দেয়নি ইজারায়েল। আসলে ইজরায়েলের সঙ্গে আইনস্টাইনকে জড়িয়ে রেখেছিল তাঁর ‘ইহুদি’ পরিচয়। নাৎসিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার মন, জার্মানিতে হিটলারের (Adolf Hitler) ইহুদি নিধনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা- কোথায় যেন তাঁর কর্মকাণ্ডের বিশ্বব্যাপী খ্যাতির সমান্তরালে ইহুদি পরিচয়টিকেও এক অন্য মাত্রা দিয়েছিল। ইজরায়েলের জেরুজালেমে হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার কাজে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তিও দান করে দিয়েছিলেন তিনি।
এদিকে ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে ইজরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন চেম ওয়েজম্যান। সেটা ১৯৪৮ সাল। প্রসঙ্গত, ওয়েজম্যান ছিলেন আইনস্টাইনের খুব ভাল বন্ধু। ১৯২১ সালে তিনিই আইনস্টাইনকে আমেরিকায় নিয়ে আসায় বিশেষ ভূমিকা নেন। সেই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অটুট ছিল আজীবন। তা এহেন ওয়েজম্যান দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরের বছরই এক বক্তৃতায় ঘোষণা করেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ইহুদি (Jews) ব্যক্তিত্বের নাম অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। এই ঘোষণার আবডালেই কোথায় যেন আইনস্টাইনের ছায়া এসে পড়েছিল সেদেশের শীর্ষ পদটির উপরে। নিঃসন্দেহে পরবর্তী সময়ে দেওয়া প্রস্তাবটির পিছনে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ভালবাসা থেকে সাধারণ মানুষের অবিমিশ্রিত শ্রদ্ধা এক অনিবার্য ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করেছিল।
মাত্র চার বছর প্রেসিডেন্ট থাকার পরে ১৯৫২ সালে মারা যান ওয়েজম্যান। তার ঠিক হপ্তাখানেকের মধ্যেই ইজরায়েলের দূতাবাস থেকে একটি চিঠি পান আইনস্টাইন। সেই চিঠিতেই ছিল ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব। সেই সময় আইনস্টাইন আমেরিকার নাগরিক। মাত্র বছর কয়েক আগে, ১৯৪০ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব পেয়েছেন। তার আগে পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের নাগরিক ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী। কিন্তু জার্মানিতে আর ফিরে যাওয়ার কথা ভাবেননি। এতাবস্থায় এই চিঠি।
ঠিক কী প্রস্তাব ছিল চিঠিতে? সেখানে বলাই হয়েছিল, দেশের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন এই প্রস্তাবটি দিয়েছেন। আইনস্টাইন যদি ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট হন, তাহলেও তাঁর বিজ্ঞান সাধনায় কোনও অন্তরায় তৈরি হবে না। এবং তাঁর গবেষণার সমস্ত দায়ভারও ইজরায়েলই নেবে। তবে শর্ত একটাই। এজন্য আইনস্টাইনকে ইজরায়েলে এসে থাকতে হবে। এবং এদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে হবে।
এমন প্রস্তাবে কী উত্তর দেবেন তা নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না আইনস্টাইনের মনে। প্রথম থেকেই তিনি জানতেন, ‘না’ ছাড়া আর কোনও উত্তর হতেই পারে না। নিঃসন্দেহে এমন প্রস্তাবে ভিতরে ভিতরে খুবই অস্বস্তিতে পড়েছিলেন প্রবীণ আইনস্টাইন। কেননা তাঁর মত ছিল, এমন প্রস্তাব তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের জন্য নেহাতই বেমানান। একথা বন্ধুমহলে প্রকাশও করে ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু সেকথা তো সরাসরি বলা যায় না। এদিকে ইজরায়েল দূতাবাস একটা টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিয়েছে, আমেরিকায় নিযুক্ত তাদের রাষ্ট্রদূত আব্বা এবান নিজে গিয়ে গিয়ে দেখা করবেন আইনস্টাইনের সঙ্গে। ওয়াল্টার আইজ্যাকসন লিখিত ‘আইনস্টাইন: হিজ লাইফ অ্যান্ড ইউনিভার্স’ গ্রন্থে এর উল্লেখ আছে। আইনস্টাইন নাকি টেলিগ্রামটা পেয়ে বলেই ফেলেছিলেন, ‘‘আরে দেখা করতে এসে হবেটা কী? যখন আমি না-ই বলব?’’
এরপর ফোনেও কথা হয় দু’জনের। তখন ইবান জানিয়ে দেন, ‘‘আমি আমার সরকারকে এটা বলতে পারব না যে আপনি ফোনেই না করে দিয়েছেন। আমাকে দেখা করে সরকারি ভাবে প্রস্তাবটা আপনাকে দিতেই হবে।’’ আসলে ইবান চেয়েছিলেন, দেখা করে আইনস্টাইনকে ব্যাপারটা খোলাখুলি বুঝিয়ে দিতে যে, দেশের প্রেসিডেন্ট হলেও তিনি মন দিয়ে বিজ্ঞানের কাজই করতে পারবেন। এই পদটি তাঁকে দেওয়ার অর্থই হল, ইজরায়েলের একজন ‘হিরো’ হিসেবে তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ পদে ঠাঁই দেওয়া। এমনিতেও প্রশাসনিক দিক থেকে ওই পদের আসল গুরুত্বই হল সম্মান। আর সেটাই তাঁর প্রতি প্রদর্শন করতে চায় ইজরায়েল।
এরপর ইবান তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করলে বিজ্ঞানী সাফ জানিয়ে দেন, এমন প্রস্তাবে গভীর ভাবে আপ্লুত হয়েও তিনি অত্যন্ত দুঃখিত ও লজ্জিত যে সেটি গ্রহণ করতে পারছেন না। তিনি মনে করিয়ে দেন মানবিক বন্ধন হিসেবে তাঁর শ্রেষ্ঠ বন্ধন ইহুদিদের সঙ্গেই। কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের সীমবদ্ধতার দিকটিও স্পষ্ট করে দেন আইনস্টাইন। বলেন, ‘‘আমি আমার সারা জীবন কাটিয়েছি বস্তুনিষ্ঠ পদার্থের সঙ্গেই। ফলে মানুষের সঙ্গে মেশার স্বাভাবিক ক্ষমতা ও অফিসিয়াল কাজকর্ম করার দক্ষতা কোনওটাই আমার নেই।’’ পাশাপাশি নিজের বৃদ্ধ বয়সের কথাও তুলে ধরেন। সব মিলিয়ে বার্ধ্যক্য ও অনভিজ্ঞতাকেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পিছনে কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন আইনস্টাইন।
আইনস্টাইন মারা যান ১৯৫৫ সালের এপ্রিলে। সুতরাং তিনি ওই প্রস্তাবে রাজি হলে খুব বেশি আড়াই বছর ইজরায়েলের প্রেসিডেন্টের পদ অলংকৃত করতে পারতেন। সময়টা খুব দীর্ঘ না হলেও ইতিহাসের পাতায় তার একটা আলাদা তাৎপর্য তৈরি হত বইকি। সক্রিয় রাজনীতির প্রতি কখনওই আগ্রহ দেখাননি আইনস্টাইন। কিন্তু বহু সময়ই স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান নিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া তার মধ্যে অন্যতম। সেই সঙ্গে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের উপরে হওয়া নির্যাতনের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিলেন তিনি। তবে সব মিলিয়ে রাজনীতির পাকা সড়কে কখনও হাঁটেননি। প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলে সেটাকে আর এড়িয়ে থাকা যেত না। জীবনের শেষবেলায় বর্ণময় এক মহাজীবনের উপরে এসে পড়ত আরও নতুন কোনও বৈচিত্রের আলো।
কিন্তু যেটা হয়নি, সেটা তো ইতিহাসের আলোচ্য বিষয় নয়। তার কৌতূহল যেটা হয়েছিল সেটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সমস্ত সম্ভাবনা শেষ হয়ে গিয়েছিল একটি ঋজু, বিনম্র ও দৃঢ় ‘না’-তেই। এবং তার পিছনে ছিল ক্ষমতার লোভের প্রতি মোহ থেকে সরে এসে নিজের অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে গভীর সত্যনিষ্ঠ ধারণা। তবে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও, ইজরায়েলের মানুষের তাঁর প্রতি সম্মান একটুও কমেনি। সেদেশে রাস্তা তৈরি হয়েছে তাঁর নামে। রয়েছে মোট চারটি স্মৃতিসৌধ। এমনকী, ১৯৬৮ সালে ইজরায়েলের নোটেও ছাপা হয়েছিল ভুবনজয়ী বিজ্ঞানীর নাম। শ্রেষ্ঠ ইহুদির যে সম্মান তাঁকে দিয়েছিলেন সেদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট, সেই শিরোপাই তাঁকে যুগ যুগ ধরে পরিয়ে এসেছে ইজরায়েল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.