বিশ্বদীপ দে: মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে যুদ্ধের ঘন কালো মেঘ। যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল গাজায়, তা এবার লেবানন হয়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে। অর্থাৎ সমস্ত সংঘাতের মূলে ইজরায়েল বনাম হামাস। ইহুদি দেশটির ‘মারে’ কোণঠাসা প্যালেস্টাইনের জঙ্গি সংগঠন। হামাসের হামলার জবাব দিতে ইজরায়েলি সেনার আক্রমণে গাজার মৃত্যুমিছিল গত একবছর ধরেই খবরের শিরোনামে। ফলে গোটা বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আলোচনায় বার বার উঠে আসছে প্যালেস্টাইন প্রসঙ্গ। আলোচনা চলছে ইজরায়েল নিয়েও। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশটির জন্ম হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। ইহুদিদের এই দেশটির জন্ম চাননি মহাত্মা গান্ধী। যদিও তার অর্থ এই নয় যে ইহুদিদের প্রতি তাঁর কোনও সহমর্মিতা ছিল না। বরং ব্যাপারটা উলটোই। আসলে বিষয়টা কিঞ্চিৎ জটিল।
১৯৩৮ সালে সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘হরিজন’-এ ‘দ্য জিউস’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে গান্ধী লিখেছিলেন, ‘প্যালেস্টাইন আরবদের। যেভাবে ইংল্যান্ড ইংরেজদের, ফ্রান্স ফরাসিদের।’ এই ইস্যুতে এটাই তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত মন্তব্য। কিন্তু এর থেকে তাঁর এবিষয়ে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে না। এই ‘হরিজন’ পত্রিকাতেই তাঁকে লিখতে দেখা গিয়েছিল, ‘সমস্ত ইহুদিদের প্রতি আমার সমবেদনা। ওরা খ্রিস্টধর্মে অচ্ছুৎ। ওদের প্রতি খ্রিস্টানদের আচরণের সঙ্গে হিন্দুদের অচ্ছুৎদের প্রতি ব্যবহারের তুলনা করা যায়। দুই ক্ষেত্রেই তাদের প্রতি হওয়া অমানবিক আচরণকে সঠিক প্রমাণ করতে ধর্মের জিগির তোলা হয়েছিল।’ সেই সঙ্গে ব্রিটেনের হিটলারকে ‘তোষণ করার নীতি’রও তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। এমনকী তিনি একথাও লিখেছিলেন যে, ‘মানবিকতার স্বার্থে এবং ইহুদিদের উপরে হওয়া নির্যাতন রুখতে জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধও শুরু করা যায়।’ তাঁর মতে, ইহুদিদের প্রতি জার্মানির দমনপীড়নের তুলনা গোটা বিশ্বেই নেই। বলাই বাহুল্য, তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়নি। তখনও নাৎসিদের ভয়াবহ নির্যাতনের সর্বগ্রাসী ছবিটা দেখেনি বিশ্ব। কিন্তু গান্ধীর নজরে ধরা পড়ে গিয়েছিল সবই। অহিংস মতাবলম্বী হয়েও এক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রতিই ছিল তাঁর সমর্থন।
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো। গান্ধীর ইহুদিদের প্রতি এই সহমর্মিতার পিছনে রয়েছে তাঁর অতীত জীবন। ১৮৯৩ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন তাঁর অধিকাংশ বন্ধুই ছিলেন ইহুদি। যাঁদের মধ্যে আলাদা ভাবে উল্লেখ করা যায় হারম্যান কালেনবাখের কথা। ইহুদি এই মানুষটি সারা জীবনই গান্ধীর ছায়াসঙ্গী হয়ে ছিলেন। এই সাহচর্য এবং দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞতা গান্ধীর ইহুদী প্রীতির প্রধান কারণ। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত মার্গারেট চ্যাটার্জির লেখা ‘গান্ধী অ্যান্ড হিজ জিউইশ ফ্রেন্ডস’ বইয়ে এপ্রসঙ্গে বিস্তারিত লেখা রয়েছে। লেখিকার মতে, দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন পূর্ব ইউরোপের ইহুদি শরণার্থীদের দেখেছিলেন গান্ধী। অনুভব করেছিলেন কীভাবে নিজেদের কোনও ‘দোষ’ ছাড়াই ভারতীয়দের মতোই আক্রান্ত হতে হচ্ছে তাদের।
এই সহমর্মিতাই পরবর্তী সময়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে গান্ধীর ইহুদিপ্রীতির কারণ হয়ে ওঠে। অচিরেই বহু ইহুদি তাঁর বন্ধু হন। জোহানেসবার্গ ও লন্ডনে গান্ধীর সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পিছনে ছিল যাঁদের সাহায্য।
সপ্তম শতাব্দী থেকেই সারা পৃথিবী জুড়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে ইহুদিরা। পরে তারা পাড়ি দেয় ইউরোপে। এই ভোগান্তির চরম ছবিটা অবশ্যই হিটলারের আমলে। কিন্তু তবুও ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র চাননি গান্ধিজি। তিনি লেখেন, ‘যদি ইহুদিদের প্যালেস্টাইন ছাড়া আর কোনও দেশ না থাকে, সেক্ষেত্রে তারা বিশ্বের বাকি অংশে যেখানে তারা বসতি স্থাপন করেছে সেখান থেকে বলপূর্বক উৎখাত হতে হলে তা মেনে নিতে পারবে কি?’ তাঁর মতে, ইহুদিদের পৃথক রাষ্ট্র হলে তা ‘জার্মানদের ইহুদি বিতারণের এক বর্ণময় সাফাই’ হয়ে উঠবে। তিনি এমনও লেখেন, ”আমি যদি ইহুদি হতাম এবং জার্মানিতে জন্মাতাম, তাহলে সেটাই স্বদেশ বলে দাবি করতাম। যেমনটা একজন দীর্ঘকায় জার্মান করবে। তাঁকে চ্যালেঞ্জ করতাম আমাকে গুলি করার কিংবা অন্ধকার কুঠুরিতে নিক্ষেপ করার। তবু বহিষ্কৃত হতে অস্বীকার করতাম।” কেবল এইটুকুই নয়। গান্ধীর আরও যুক্তি ছিল, ‘ইহুদিদের আরবে ঠেলে দেওয়াটা ভুল ও অমানবিক হবে। গর্বিত আরবদের সংখ্যা হ্রাস করে প্যালেস্টাইনকে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে ইহুদি রাষ্ট্র করা হলে তা হবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।’
তবে অনেকেরই মতে গান্ধী পরে মত বদলান। মহাত্মার জীবনীকার লুই ফিশারের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনে এই দিকটি উঠে এসেছিল। তাঁকে বলতে শোনা যায়, ”ইহুদিদের দাবির যৌক্তিকতা রয়েছে। আমি ব্রিটিশ ইহুদি সাংসদ সিডনি সিলভারম্যানকে বলেছিলাম যে প্যালেস্টাইন নিয়ে ওদের দাবিতে ভুল নেই। যদি আরবরা প্যালেস্টাইন নিয়ে দাবি জানাতে পারে, সেক্ষেত্রে ইহুদিরা তো আগেই একই দাবি জানিয়ে রেখেছে।” কিন্তু এই মতই তাঁর একমাত্র মত তা নয়। সেদিক দিয়ে দেখলে ফিশারের লেখাটি ছাড়া গান্ধীর এমন মত অন্যত্র কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। বরং ১৯৪৬ সালেরই জুলাই মাসে ‘জিউস অ্যান্ড প্যালেস্টাইন’ প্রবন্ধে তিনিই লিখেছিলেন ”ইহুদিদের উপরে হওয়া নির্মম নিপীড়নের পরে, বোধহয় তাদের প্যালেস্টাইনে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না।” পাশাপাশি তাঁর আরও মত ছিল যে আমেরিকা ও ব্রিটেনের সাহায্যে তো বটেই, ‘নগ্ন সন্ত্রাসে’র সাহায্যেও প্যালেস্টাইন দখল করতে চাইছে ইহুদিরা।
আসলে ১৯২৩ সালে স্বাধীন তুরস্কের জন্ম হওয়ার পর ইহুদিরা নিজেদের জন্য রাষ্ট্রের দাবিতে সরব হয়। তার আগে ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রীও একটি চিঠিতে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতিও দেন। এহেন পরিস্থিতিতে ব্রিটেন এমনও কথা দেয় য়ে তারা তাদের নিজস্ব ভূমিও ছেড়ে দিতে পারে সেজন্য! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ ইজরায়েলে চলে যান। যুদ্ধশেষে আরও বহু ইহুদি একই ভাবে ইজরায়েলে জড়ো হন। শেষপর্যন্ত ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে ইজরায়েল গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঠিক হয় ৪৫ শতাংশ প্যালেস্তিনীয়দের দিয়ে বাকি ৫৫ শতাংশ ইহুদিদের দেওয়া হবে। এর পর সে বছরের ১৪ মে ইজরায়েল স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ততদিনে গান্ধী প্রয়াত। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি নাথুরাম গডসের বুলেটে প্রাণ হারিয়েছেন ‘জাতির জনক’। ফলে এই বিষয়ে সেই সময় তাঁর মতামত কী হতে পারত তা কেবলই ইতিহাসের চিরন্তন এক আলোচনার অংশ হয়েই থেকে যাবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.