Advertisement
Advertisement
Mikhail Gorbachev

গ্লাসনস্ত কী, কী-ই বা পেরেস্ত্রইকা? গর্বাচভের হাত ধরে কীভাবে ভাঙল সোভিয়েত

সোভিয়েতে কেন সংস্কার চেয়েছিলেন গর্বাচভ?

What is Mikhail Gorbachev's glasnost and perestroika? | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:August 31, 2022 4:03 pm
  • Updated:September 1, 2022 7:34 pm  

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ‘এখানে এসে আমার চোখে সবচেয়ে ভাল লেগেছে, ধনগরিমার ইতরতার সম্পুর্ণ তিরোভাব।’ তিরিশের দশকে ‘রাশিয়ার চিঠি’তে সাম্যবাদ ও জনসাধারণের আত্মমর্যাদার এক অদ্ভুত মহিমামণ্ডিত ছবি এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভারতে এহেন দিন দুরাশা জেনে কিছুটা আক্ষেপও যেন ঝরে পড়েছিল তাঁর শব্দে। কিন্তু, দুরদর্শী কবিগুরু কোথাও যেন ইঙ্গিত পেয়েছিলেন, ‘কমিউনিজম খুব ভাল স্বপ্ন, কিন্তু স্বপ্ন বলেই স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কাও রয়েছে।’ আর কয়েক দশক পরে সেই আশঙ্কাই সত্যি হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ তথা বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভের হাত ধরে। তাঁর ‘গ্লাসনস্ত’ ও ‘পেরেস্ত্রইকা’ নীতিই নাকি ছিল কমিনিস্ট মহাশক্তির পতনের অন্যতম কারণ।

কী এই গ্লাসনস্ত? কী-ই বা পেরেস্ত্রইকা? কেনই বা পরিবর্তনের নায়ক গর্বাচভ, সোভিয়েত ইতিহাসে হয়ে উঠলেন খলনায়ক? এই উত্তরের খোঁজ চলছে এবং চলবে। এনিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। নির্দিষ্ট শব্দবন্ধে সোভিয়েত ইতিহাসের এই বিতর্কিত চরিত্রের প্রতি ন্যায় করা অসম্ভব। এই প্রতিবেদনে দুঃসাধ্য সেই চেষ্টাও করা হয়নি। তবে গর্বাচভের প্রয়াণে অতীতের সেই দুনিয়া কাঁপানো দিনগুলিতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া আজ সময়ের দাবি।

Advertisement

কী এই গ্লাসনস্ত?

গ্লাসনস্ত শব্দের অর্থ হচ্ছে মুক্তবস্থা বা খোলা হাওয়া (open air)। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ মানবধিকার ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন তাই হচ্ছে গ্লাসনস্ত। যদিও ইতিহাসবিদদের মতে ১৯৮৬ সাল থেকেই সোভিয়েত সমাজে ‘গ্লাসনস্ত’-এর ধারণা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন গর্বাচভ ও তাঁর অনুগামীরা। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন দলের অন্দরে পরিবর্তন ও সংস্কারের জন্য জোরাল আওয়াজ তোলেন তিনি।

[আরও পড়ুন: প্রয়াত সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ

বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, স্টালিন জমানা থেকেই এক লৌহবেষ্টনিতে মুড়ে ফেলা হয় সোভিয়েত সমাজকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপ থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বয়ে যায় ‘লালঝড়’। আকার আয়তনে বিশালাকৃতি ধারণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু সংস্কৃতি, ভাষা বা ধর্মের নিরিখে ওই ‘রামধনু’ দেশকে একসুতোয় বাঁধতে গিয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার কার্যত কেড়ে নেয় রাষ্ট্র। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো দুর্নীতি প্রবেশ করে শাসন ব্যবস্থার অন্দরে। কোনও ধরনের প্রতিবাদ বা মতান্তরকেই ‘প্রতিবিপ্লবী’ তকমা দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয়। যাজকতন্ত্র, গির্জা ও মসজিদের প্রভাব ক্ষুণ্ণ করতে অত্যন্ত কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সবমিলিয়ে, সাম্যবাদের ‘ইউটোপিয়া’ গড়ে তোলার চেষ্টায় ব্যক্তি পরিচয় অস্তিত্ব কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর তার ফলেই জনমানসে বিক্ষোভের বারুদ জমা হতে শুরু করে। এই অবস্থা থেকেই মুক্তি পেতেই গ্লাসনস্ত নীতি এনেছিলেন গর্বাচভ। তিনি মনে করেছিলেন, ‘সেফটি ভালভ’ থিওরি মেনে জনগণ খানিকটা উষ্মা প্রকাশের সুযোগ পেলে তা বড়সড় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের আকার নেবে না।

কী-ই বা পেরেস্ত্রইকা?

পেরেস্ত্রইকা শব্দের অর্থ হচ্ছে পুনর্গঠন। আর্থিক ও সামাজিক সংস্কার করতে ১৯৯০ সালে এই নীতি প্রবর্তন করেন প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ। ওই সময় দেশকে নতুন দিশায় নিয়ে যেতে যে পুনর্গঠন প্রকৃত শুরু করেছিলেন তিনি, সেটাই পেরেস্ত্রইকা। এর উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রের রাশ কিছুটা আলগা করে জনতার ক্ষোভ প্রশমিত করা।

এই নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজতন্ত্রের আধারে এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে থাকবে একটি দক্ষ অর্থনীতি এবং সর্বোপরি একটি উন্নত বিজ্ঞান প্রযুক্তি নির্ভর ও গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো। শীতযুদ্ধের প্রয়োজনে সোভিয়েত ইউনিয়ন মূলত ভারী শিল্প বিশেষত সামরিক শিল্পের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। ফলে তথ্যপ্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক বা এই ধরনের বিলাস দ্রব্যের উৎপাদন পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। একই সাথে বিশ্ববাণিজ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন পিছিয়ে পড়েছিল। বাণিজ্য কেবল পূর্ব ইউরোপ এবং সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির সঙ্গেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক উদারীকরণ এর নীতি গৃহীত হয়। সোভিয়েত বাজার বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার কাছে উন্মুক্ত হয়। সোভিয়েত অর্থনীতিও বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন পায়। পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রমশ কমান্ড ইকোনমি থেকে মার্কেট ইকোনোমির দিকে অগ্রসর হয়।

গর্বাচভের নীতিই কি সোভিয়েত উনিয়নের পতনের কারণ?

গর্বাচভ সংস্কার শুরু করেছিলেন সোভিয়েতকে আরও মজবুত করতে। কিন্তু এতে হীতে বিপরীত হয় বলেই ধারণা বিশ্লেষকদের একাংশের। সংস্কার বিরোধীদের বিক্ষোভে পার্টির অভ্যন্তরে তীব্র গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। বরিস ইয়েলৎসিন এর নেতৃত্বে পূর্ণমাত্রায় বাজার অর্থনীতি-সহ উদারীকরণ এবং রুশ কমিউনিস্ট পার্টিকে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে রূপান্তরের দাবি জোরাল হয়ে ওঠে। গর্বাচভের সঙ্গে মতপার্থক্যের জেরে মস্কোর পার্টি প্রধানের পদ থেকে বরিশ ইয়েলৎসিনকে বহিষ্কার করা হয়। অন্যদিকে, সংস্কারবিরোধীরা ইগর লিগাচেভ ও ভি আই ভোরেতনিকভ-এর নেতৃত্বে জোট বাধে। পার্টির সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ার জন্য গর্বাচভকেই তাঁরা দায়ী করেন। তবে বিশ্লেষকদের অন্য এক অংশের মতে, চেরনোবিল পরমাণু কেন্দ্রের ঘটা দুর্ঘটনাই ছিল সোভিয়েত উনিয়নের কফিনে শেষ পেরেক। আমেরিকার সঙ্গে ঠান্ডা লড়াইয়ের আবহে অর্থনীতির এহেন ক্ষতি সামলাতে পারেনি মস্কো। একইসঙ্গে, ঘটনটিকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রয়াস আমজনতারে মনে যে ক্ষোভ জন্ম দিয়েছিল তা বিরাট বিদ্রোহের আকার নেয়। তারপর বার্লিন ওয়ালের পতন আজ ইতিহাস।  

পার্টির মধ্যে প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যগুলিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয় এমনকি মূল রুশ ভূখণ্ডে বরিশ ইয়েলৎসিনের উস্কানিতে রুশ প্রজাতন্ত্রের বিচ্ছিন্নতার দাবি বেশ জনপ্রিয় হয়। জর্জিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া প্রভৃতি প্রজাতন্ত্রগুলি বিচ্ছিন্নতার দাবি নিয়ে হাজির হয়। মুসলিম অধ্যুষিত আজারবাইজান-এ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী জনগণ বিচ্ছিন্নতার দাবি তোলে এবং কিছুদিন পরেই সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় যার উপর মস্কোর কোন নিয়ন্ত্রণই ছিল না। এদিকে, গর্বাচভ প্রবর্তিত সংস্কারগুলিও বিশেষ সফল হয়নি। এই অবস্থায় গর্বাচভ গণভোটের মাধ্যমে ন’টি প্রজাতন্ত্রকে আরও অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব দেন। যদিও মোলডাভিয়া, জর্জিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও কিরঘিজস্তান এই গণভোটে অংশ নেয়নি। নতুন ব্যবস্থায়, গর্বাচভের হাতে থেকে যায় কেবল অর্থ, প্রতিরক্ষা ও বিদেশমন্ত্রক।

অন্যদিকে, কট্টরপন্থীদের একটি পদক্ষেপ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন কে আরও ত্বরান্বিত করে। সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা (KGB) সম্মিলিতভাবে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। তখন গর্বাচভ ক্রাইমিয়ায়। এই ঘটনায় কমিউনিস্ট পার্টি আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং প্রজাতন্ত্রগুলির সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি আনুগত্য কার্যত বিলুপ্ত হয়। মর্মাহত গর্বাচভ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দেন। তারপরই বরিস ইয়েলৎসিন রাশিয়াকে কেন্দ্র করে পূর্বতন প্রজাতন্ত্রগুলিকে নিয়ে একটি রাষ্ট্র সমবায় গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। ১৯৯১ সালের ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম সোভিয়েতের কার্যভার রাশিয়ার পার্লামেন্টের উপর অর্পিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রকাঠামোর ধ্বংস সম্পূর্ণ হয়। আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন ও পূর্বতন অঙ্গরাজ্য গুলির জোট Commonwealth of Independent States বা CIS। ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৯১ গর্বাচেভ সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রধানের পদ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইস্তফা দেন। এইভাবে দীর্ঘ ৭৪ বছরের গৌরবময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে।

[আরও পড়ুন: ভয়ংকর বন্যায় দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি দেশে, খাদ্যপণ্যের জন্য ভারতের শরণাপন্ন পাকিস্তান

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement