বিশ্বদীপ দে: যেন কোনও হলিউডি ছবির চোখ ধাঁধানো স্পেশাল এফেক্টস। আজ থেকে প্রায় দু’দশক আগে টিভির পরদায় চোখ রেখে এমনটাই মনে হয়েছিল সারা পৃথিবীর। যদিও সঙ্গে সঙ্গে চোখ কচলে সকলে বুঝেছিল, যা তারা দেখছে তা নিখাদ বাস্তব। সত্যি সত্যি ঘটেছে। ইতিহাসের ৯/১১ (9/11) অধ্যায়ের ২০ বছর পূর্ণ হবে এবারের সেপ্টেম্বরে। তার আগে গত ২ মে পেরিয়ে গেল সময়খণ্ডের আর একটা মাইলফলকের বর্ষপূর্তি। ৯/১১ অপারেশনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ অর্থাৎ কিনা নাটের গুরুকে খতম করার এক দশক পূর্ণ হল। কে সেই নাটের গুরু? বোধহয় পৃথিবীর সহজতম প্রশ্ন। আফ্রিকার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে পশ্চিমবঙ্গের মফস্বলের কোনও খালের পাশে থাকা নিরিবিলি চায়ের দোকান, সব স্থানেই উত্তর মিলবে। শুধু উত্তর নয়, সঙ্গে মিলবে আরও নানা তথ্য। যার কিছু সত্যি, কিছু গুজব। আমেরিকার টুইন টাওয়ারে বিমান হামলার মতোই ধীরে ধীরে এক মিথ হয়ে উঠেছে স্বয়ং লাদেন (Osama bin Laden) ও অ্যাবোটাবাদে গভীর রাতে তার হত্যার নাটকীয় মুহূর্তও। কিন্তু যদি বলা হয় শাকিল আফ্রিদির কথা? কে তাঁর খোঁজ রেখেছে? খোদ আমেরিকাই বোধহয় ভুলতে বসেছে। এই লেখা সেই বিস্মৃতপ্রায় আফ্রিদিকে নিয়েই।
২০১১ সালের ২ মে গভীর রাতে আফগানিস্তান থেকে যখন মার্কিন (US) হেলিকপ্টারগুলি উড়ে গিয়েছিল পাকিস্তানের (Pakistan) উদ্দেশে, তার আগে ছিল অনেক হিসেব মিলিয়ে নেওয়ার অধ্যায়। প্রায় তিন মাস ধরে চলছিল সলতে পাকানো। কারণ একেবারে নিশ্চিত না হয়ে ওসামা বিন লাদেনের ডেরায় অভিযান চালাতে নারাজ ছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আর শেষ পর্যন্ত তাঁকে নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন যিনি, তিনিই শাকিল আফ্রিদি (Shakeel Afridi)। পাকিস্তানের বাসিন্দা। পেশায় চিকিৎসক। কিন্তু আদতে মার্কিন চর। বলা ভালো সিআইএ-র এজেন্ট। লাদেন হত্যার দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অনেক কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। নরকের দরজা পর্যন্ত তাড়া করে কীভাবে শেষ পর্যন্ত নাগাল পাওয়া গিয়েছিল লাদেনকে, সেকথা সবিস্তারে বলেছেন। কিন্তু শাকিলের কথা আলাদা করে উল্লেখ করেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর কথা মনেই পড়েনি বাইডেন সাহেবের।
এই মুহূর্তে কোথায় রয়েছেন শাকিল? গত এক দশক ধরে বাইরের পৃথিবীতে পা পড়েনি তাঁর। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শাহিওয়াল জেলের এক ছোট্ট খুপড়িই এখন শাকিলের বিশ্ব। সাত ফুট বাই আট ফুট। এটাই তাঁর কাছে পৃথিবীর মাপ। ৩৩ বছরের জন্য তাঁকে কারাবাসের দণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেখানেই দিন কাটে। সকাল হয়। দুপুর গড়ায়। রাত হয়ে যায়। পৃথিবী ঘুরে আসে একটা চক্কর। কত কিছু বদলে গিয়েছে গত এক দশকে। সেসবের থেকে বহু দূরে রয়ে গিয়েছেন ‘অপারেশন নেপচুন স্পিয়ার’-এর এক অন্যতম কুশীলব। দেশের মাটিতে তিনি ‘বিশ্বাসঘাতক’। আমেরিকায় ‘নায়ক’। এই সময়ে দাঁড়িয়ে বলা উচিত ‘বিস্মৃত নায়ক’।
ঠিক কী করেছিলেন শাকিল? আগেই বলেছি, লাদেন যে অ্যাবোটাবাদের পাঁচিলঘেরা রহস্যময় বাড়িটায় রয়েছেন তার একটা অকাট্য প্রমাণ দরকার ছিল। তাই তাকে চিহ্নিত করতেই ওই এলাকায় শুরু হয় এক ভুয়ো হেপাটাইটিস বি টিকাকরণ শিবির। যেহেতু বিষয়টাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে, তাই এলাকার দরিদ্র অঞ্চলেই প্রথম টিকাকরণ শুরু হয়েছিল। এলাকা ছেয়ে গিয়েছিল পোস্টারে। শহরের স্বাস্থ্য দপ্তরকে কায়দা করে কাটিয়ে দিয়ে মূলত স্থানীয় প্রশাসনকে হাত করে নিয়ে ওই টিকাকরণ শুরু করেছিলেন শাকিল। সঙ্গে পেয়েছিলেন স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের। তাঁদের কারও কোনও রকম ধারণা ছিল না কত বড় আন্তর্জাতিক অপারেশনের অঙ্গ হয়ে পড়ছেন তাঁরা। হয়তো শাকিলের বিশ্বস্ত নার্স মুখতার বিবির মতো কেউ কেউ সামান্য আঁচ পেয়েছিলেন। তবে বিষয়টা এতই বড়, যে স্রেফ আন্দাজ করে বুঝে ফেলা অসম্ভব।
কীভাবে যে নিশ্চিত হওয়া গেল ওখানে লাদেন আছে, সেটা পরিষ্কার ভাবে জানা যায়নি। তবে মনে করা হয়, লাদেনের শরীর থেকে নমুনা নেওয়া সম্ভব না হলেও তাঁর পরিবারের কোনও কোনও সদস্যদের ডিএনএ নমুনা নেওয়া গিয়েছিল টিকাকরণের অছিলায়। যা মিলিয়ে দেখা হয়েছিল ২০১০ সালে প্রয়াত লাদেনের বোনের ডিএনএ-র সঙ্গে। আর তাতেই কেল্লা ফতে। ওয়াশিংটন নিশ্চিত হয়ে যায়, ওই বাড়িতেই রয়েছে তাদের সেই ‘অমূল্য রতন’ যাকে এতদিন ধরে খুঁজে চলেছে তারা। কোনও ছাইয়ের স্তূপই হয়তো বাকি রাখেনি।
এরপর একদিন অন্ধকার রাতে ৪৫ মিনিটের সেই অপারেশন। হোয়াইট হাউসে বসেই যা ‘লাইভ’ দেখেছিলেন ওবামা। পরে গোটা পৃথিবী জেনে গিয়েছিল, লাদেন খতম। নিউজ চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ থেকে খবরের কাগজের প্রথম পাতা হয়ে সারা পৃথিবীতে লাদেন হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার কিছুদিনের মধ্যেই ধরা পড়েন শাকিল আফ্রিদি। আজ পর্যন্ত আদালতে প্রমাণ করা যায়নি শাকিলের চরবৃত্তির অভিযোগ। কিন্তু কোনও এক ঝাপসা আইনকে কাজে লাগিয়ে এক বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে অর্থ সরবরাহের অভিযোগ এনে ৩৩ বছরের সাজা শোনানো হয় শাকিলকে। আমেরিকা সেই সময় বিস্ময় প্রকাশ করে জানিয়েছিল, কী করে আমেরিকা লাদেনের সন্ধান পেল এটা ভেবে পাকিস্তান এত উত্তেজিত! অথচ পাঁচ বছর ধরে লাদেন সেখানে কী করে আস্তানা গেড়ে লুকিয়ে রইলেন তা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই!
ব্যাস! শাকিলের রোমাঞ্চকর ঘটনাবহুল জীবনে সেইখানেই যতিচিহ্ন পড়ে গেল। দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে সময়। ওই ঘুপচি সেলেই রয়ে গিয়েছেন শাকিল। তাঁর কাছে কোনও মোবাইল ফোন নেই। কোরান ছাড়া অন্য কোনও বই নেই। খবরের কাগজ আসে না। এমনকী জেলের অন্য বন্দিদের সঙ্গেও মেলামেশার সুযোগও নেই। কেবল আত্মীয়স্বজন ও আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলা যায়। তবে তা মাসে কেবল দু’বার। এবং সেটাও তারজালির ওপারে দাঁড়িয়ে। সেখানেও জেল কর্তৃপক্ষের কড়া নির্দেশ, বন্দি জীবনের কোনও অসুবিধা কিংবা পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, এই ধরনের কোনও রকম আলোচনা সেখানে কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।
আমেরিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হুসেন হাক্কানি সংবাদ সংস্থা এএফপিকে শাকিল সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, ‘‘ওঁকে এখনও জেলে রেখে দেওয়া হয়েছে প্রত্যেক পাকিস্তানিকে এটা বোঝাতে যে, পশ্চিমি গোয়েন্দাদের সঙ্গে হাত মেলালে কী হাল হতে পারে।’’ এদিকে ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারে দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের সহকারী ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যানের আর্তি, ‘‘একটা ব্যাপার পরিষ্কার। আফ্রিদিকে সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হয়েছে।’’ সেই সঙ্গে তিনি এও মানছেন, শাকিল এখন আর কোনও ‘ইস্যু’ নন। যদিও একসময় আমেরিকার তরফে বারবার প্রতিবাদ হয়েছে তাঁকে এভাবে বন্দি করে রাখার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও প্রতিবাদই দানা বাঁধেনি। ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গিয়েছেন শাকিল। পাকিস্তানের এক স্পাই এজেন্সির প্রাক্তন প্রধান আসাদ দুরানি অবশ্য মনে করছেন শাকিলের কপাল ভাল! জেলবন্দি না হলে হয়তো গণপিটুনির সামনে পড়তে হত তাঁকে। তাঁর কথায়, ‘‘বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে চরবৃত্তি করাটা অমার্জনীয় অপরাধ।’’
এটাই শাকিলের পরিণতি। স্বদেশে চূড়ান্ত ঘৃণ্য গণশত্রু। আর আমেরিকায় প্রায় বিস্মৃত। অবশ্য এসবের থেকে তিনি এই মুহূর্তে বহু দূরে। দিনের পর দিন অন্ধকার ঘুপচি ঘরে থাকতে থাকতে হয়তো স্বপ্নেও অন্ধকারই দেখেন। অথবা তা নয়। অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার স্বপ্ন ঠিকই বুকের মধ্যে লালন করে রেখেছেন। আর বিশ্বাস রেখে চলেছেন, একদিন সেই স্বপ্ন সত্যি হবেই। এই বিশ্বাসটুকু না থাকলে এতগুলো বছর কি ওই ঘুপচি ‘পৃথিবী’তে কাটাতে পারতেন তিনি?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.