Advertisement
Advertisement
Mossad

মোসাদের শত্রুতা যেন ‘ঈশ্বরের ক্রোধ’! নিঃশব্দে কার্যসিদ্ধিতে সেরা ইজরায়েলি গুপ্তচররা

হামাস-ইজরায়েল সংঘর্ষের আবহে ফিরে এসেছে তাদের 'র‌্যাথ অফ গড' মিশনের কথা।

The stories of Israel's spy agency Mossad's missions are more thrilling than a movie। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:November 25, 2023 8:17 pm
  • Updated:August 3, 2024 3:20 pm  

বিশ্বদীপ দে: ১২ নভেম্বর, ২০১১। তেহরানের কাছে ইরানের এক গুপ্ত মিসাইল ঘাঁটি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল ভয়ংকর বিস্ফোরণে। মারা গেলেন সতেরো জন রেভোলিউশনারি গার্ড। অসংখ্য মিসাইল রয়ে গেল বিস্ফোরণে তৈরি হওয়া অতিকায় লৌহপিণ্ডের গর্ভে। এই বিস্ফোরণে রাতারাতি বিরাট ধাক্কা খেল ইরান। অনেকে ভাবলেন এই হামলার আসল উদ্দেশ্য বোধহয় দূরপাল্লার শেহাব মিসাইলের ‘বাবা’ জেনারেল হাসান তেহরানি মোগাদ্দামের হত্যা। কিন্তু তা নয়। এই অপারেশনের আসল লক্ষ্য ছিল এক দুরন্ত রকেট ইঞ্জিন। যার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় কঠিন পদার্থ। ছহাজার মাইল দূরে মার্কিনভূমে পরমাণু হামলা চালানোর ক্ষমতাসম্পন্ন ওই ইঞ্জিনও ধ্বংস হয়ে যায় হামলায়। কিন্তু তা বলে মোটেই ওই হামলা আমেরিকা চালায়নি। চালিয়েছিল ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। জগৎজোড়া যাদের খ্যাতি। গোপনে নিপুণ পরিকল্পনায় তাদের একের পর এক নির্ভীক অপারেশন গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে বার বার। কেবল ইজরায়েল নয়, পশ্চিমি দেশগুলির জন্যও তারা চূড়ান্ত গোপন সব মিশন চালিয়েছে।

এবছরের গোড়ায় মুক্তি পেয়েছিল শাহরুখ খানের ‘পাঠান’। ছবিতে কিং খান ছিলেন ‘র’-এর গুপ্তচর। ছবির উত্তুঙ্গ সাফল্য আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছিল স্পাই ব্যাপারটার প্রতি মানুষের আগ্রহ ঠিক কতটা। আর চিরকালীন স্পাই জেমস বন্ড তো আছেনই তাঁর ‘লাইসেন্স টু কিল’ নিয়ে। এই সবের পাশাপাশি মোসাদ নামটা উচ্চারিত হলেও সারা বিশ্বের অসংখ্য মানুষের চোখ ঝিকমিকিয়ে ওঠে দুরন্ত সব মিশনের কাহিনিতে। এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বের নজরে ইজরায়েল। বছর দেড়েক ধরে চলতে থাকা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের থেকে ফোকাস ঘুরেছে হামাস-ইজরায়েল সংঘর্ষের দিকে। আর তার ফলেই নতুন করে আলোচনায় উঠে আসছে মোসাদের নাম। কেন হামাসের রকেট হামলার আগাম আঁচ পেল না বিশ্বখ্যাত সংস্থাটি, উঠছে প্রশ্ন। পাশাপাশি ইজরায়েলের (Israel) প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জানিয়ে দিয়েছেন, ”আমি মোসাদকে (Mossad) নির্দেশ দিয়েছি হামাসের (Hamas) মাথাদের নিকেশ করতে, যেখানেই তারা থাকুক না কেন।” নেতানিয়াহুর এই ঘোষণার পরই গুঞ্জন শুরু হয়েছে। অনেকেরই স্মৃতিতে ফিরে এসেছে পাঁচ দশক আগের ‘র‌্যাথ অফ গড’। সেকথায় আসার আগে একবার মোসাদের জন্মবৃত্তান্ত বলে নেওয়া যাক।

Advertisement
Israel's top apy unit to hunt down those behind Hamas attack, claims report
নেতানিয়াহুর মুখে ফের শোনা গেল মোসাদের নাম

[আরও পড়ুন: লজ্জায় মুখ ঢাকছে বাণিজ্য নগরী! মুম্বইয়ে দশ বছরে ধর্ষণ বেড়েছে ১৩০ শতাংশ]

১৯৪৮ সালের ১৪ মে গঠিত হয় ইজরায়েল। গোড়া থেকেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে লড়াই বেঁধেছে তাদের। ফলে দেশের প্রতিরক্ষার বিষয়টি নিয়ে সতর্কতা ছিল। অন্য দেশগুলির দিকে নজর রাখার পরিকল্পনা থেকেই জন্ম নিয়েছিল মোসাদ। ১৯৪৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর। প্রাথমিক ভাবে নাম ছিল ‘সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট ফর কোঅর্ডিনেশন’। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়নই ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে সাত দশক ধরে একের পর এক মিশনে যুক্ত থেকেছে মোসাদ। গোপন তথ্য সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করা থেকে নানা রকম মিশন রয়েছে তাদের। ‘অপারেশন অপেরা’, ‘অপারেশন এন্টেব্বে’র মতো অসংখ্য অপারেশনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মোসাদের নাম। কিন্তু ‘র‌্যাথ অফ গড’ নিয়ে আলোচনাই সবচেয়ে বেশি। ১৯৭২-এর মিউনিখ অলিম্পিক হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে ‘অপারেশন র‍্যাথ অফ গড’ (Operation Wrath of God) শুরু করেছিল ইজরায়েল। ইউরোপ-সহ বিশ্বজুড়ে প্যালেস্তিনীয় জঙ্গি সংগঠন ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’-এর নেতাদের হত্যা করে মোসাদ। স্পিলবার্গের ‘মিউনিখ’ (২০০৬) ছবিটি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন সেই ছবির মূল অবলম্বন এই অপারেশনই।

ঠিক কী ঘটেছিল? ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিক। ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ নামের এক প্যালেস্তিনীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর আটজন সদস্য মিলে সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে আগে ঢুকে পড়ে অলিম্পিক ভিলেজে। তাদের হাতে কালাশনিকভ। সঙ্গে ছিল গ্রেনেডও। আর লক্ষ্য ছিল ইজরায়েলি অ্যাথলিটরা। দুজন খেলোয়াড়কে ঘটনাস্থলেই খুন করে জঙ্গিরা। অপহরণ করে নেয় ৯ জনকে। তাঁদের পণবন্দি রেখে দাবি করে ইজরায়েলের হাতে বন্দি ২৩৬ জন পণবন্দিকে ছাড়লে তবেই মুক্তি দেওয়া হবে অপহৃতদের। গোটা বিশ্ব শিউরে উঠেছিল এই ঘটনায়। অলিম্পিকের ইতিহাসে এ একেবারে নজিরবিহীন। লাইভ টেলিভিশনে ৯০ কোটি মানুষের চোখ ছিল অলিম্পিক ভিলেজের দিকে। শেষপর্যন্ত বন্দিদের উদ্ধারে গুলির লড়াই শুরু করে জার্মানি পুলিশ। শেষপর্যন্ত পাঁচজন জঙ্গির মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু বাকি ৯ পণবন্দি ও এক জার্মান পুলিশ অফিসারের মৃত্যুও আটকানো যায়নি।

গোটা বিশ্বজুড়ে নতুন করে চর্চা শুরু মোসাদকে নিয়ে

[আরও পড়ুন: ওড়িশা থেকে উদ্ধার বাংলার নিখোঁজ কলেজ ছাত্রের দেহ, সন্তানহারা আরামবাগের পরিবার]

আর এই ঘটনার পরই ইজরায়েল বোমা ফেলতে থাকে ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ তথা পিএলওর ঘাঁটিতে। সিরিয়া ও লেবাননের হামলায় প্রাণ হারান ২০০ মানুষ। কিন্তু ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ এর মধ্যে ফের একটি বিমান অপহরণ করে ফেলে। লুফথানসার সেই বিমানটিকে হাইজ্যাক করে তারা দাবি করে জার্মানির (তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির) জেলে থাকা তিন জঙ্গিকে মুক্তি দেওয়া হোক। সেই ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন গোল্ডা মেয়ার। এবার তিনি নড়েচড়ে বসলেন। পুরোদমে প্ল্যান কষা শুরু হল। ডাক পড়ল মোসাদের। নীল নকশা ছকা হল এক গুপ্ত মিশনের। নাম দেওয়া হল ‘অপারেশন র‍্যাথ অফ গড’। বাংলায় যার অর্থ ‘ঈশ্বরের ক্রোধ’। কারা ছিল এই মিশনের টার্গেট? মিউনিখ অলিম্পিকের সময় হামলার পিছনে থাকা যে কেউ!

মিউনিখ হামলার মাত্র ছসপ্তাহের মধ্যেই রোমে মৃত্যু হল ওয়ায়েল জোয়াইটার। মোসাদ এজেন্টদের হাতে গুলি খেয়ে মরতে হয় প্যালেস্তিনীয় ওই অনুবাদককে। সন্দেহ ছিল, ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’কে অর্থ জোগান দেন ওয়ায়েল। নিজের বাড়ির লবিতেই অতর্কিত মৃত্যুর ছোবলে ঢলে পড়েন তিনি।

অনেকেরই স্মৃতিতে ফিরে এসেছে পাঁচ দশক আগের ‘র‌্যাথ অফ গড’

পরের টার্গেট মাহমুদ হামশারি। প্যারিসে থাকতেন। পিএলওর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, এই সন্দেহ ছিল তাঁকে ঘিরে। ইটালির সাংবাদিক সেজে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এক ইজরায়েলি। ওটাই তাঁর ‘কাজ’ ছিল। মাহমুদকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে নিয়ে আসা, যাতে মোসাদের এজেন্টরা সেখানে বোমা লুকিয়ে রেখে আসতে পারেন। পরদিন সেই ‘সাংবাদিক’ই একটি ফোন করেন মাহমুদকে। তিনি সাড়া দিতেই পরিষ্কার হয়ে যায়, বাড়িতেই আছেন। কারণ তখন মোবাইল নয়, ল্যান্ডলাইনেরই যুগ। এর পর মোসাদের একটাই কাজ ছিল। বোমাটিতে দূর থেকে বিস্ফোরণ ঘটানো!

ইজরায়েলের পরবর্তী সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইহুদ বারাকও একটি মিশনে যান বেইরুটে। মহিলা সেজে। ব্রেসিয়ারের ভিতরে হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে! এই ভাবে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে একের পর এক হত্যা। বেডসাইড ল্যাম্পের তলা থেকে শুরু করে বাস, ‘টার্গেট’কে খতম করতে কোথায় না বোমা লুকিয়েছিল মোসাদ!

একের পর এক অপারেশনে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে মোসাদ

কিন্তু ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে একটা ভুল হয়ে গেল। ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরে’র মাথা ভেবে নরওয়েতে মরক্কোর এক নিরীহ নাগরিককে হত্যা করে ফেলল মোসাদ। এই মৃত্যুর পর শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। তখনই অপারেশন শেষ না হলেও, সুর খানিকটা যে কেটে গিয়েছিল তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। পরবর্তী দুই দশক ধরেই এই অপারেশন চলেছিল। কিন্তু অভিযোগ উঠতে থাকে, সব সময় মোসাদ যে প্যালেস্তিনীয়দের আক্রমণ করেছে তাঁরা সকলেই প্রত্যক্ষ ভাবে ‘মিউনিখ ম্যাসাকারে’র সঙ্গে জড়িত, তা নয়। অনেকেই বুদ্ধিজীবী কিংবা রাজনীতিক। সমালোচকদের দাবি, এঁদের সঙ্গে ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরে’র যোগাযোগ খুবই ক্ষীণ। আর এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে টেনশনও শুরু হয়।

কিন্তু ওই অপারেশনে নরওয়ের ঘটনাটিই মোসাদের গায়ে লেগে থাকা সবচেয়ে বড় কলঙ্ক। পাশাপাশি মনে করা হয়, ‘অপারেশন র‍্যাথ অফ গডে’র ফলেই ইজরায়েলের গোয়েন্দা অভিযানে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। এবং মোসাদের এক এজেন্ট একবার দাবি করেছিলেন, ওই অপারেশন না হলে আরও বেশি জঙ্গি হামলার মুখে পড়তে হত ইজরায়েলকে। কেননা তাহলে প্যালেস্তিনীয় জঙ্গিরা ভেবে নিত তারাই বেশি শক্তিশালী।

মোসাদের এক প্রাক্তন বড় কর্তা ডেভিড কিমচে একবার দাবি করেছিলেন, চাইলেই তাঁরা রাস্তাতেই ‘টার্গেট’কে গুলি করে খুন করে দিতে পারতেন। কিন্তু ফোনের মধ্যে লুকনো বোমা এই বার্তা দেয়, মোসাদ থাকতে পারে যে কোনও জায়গাতেই! তবে উলটো প্রশ্নও রয়ে গিয়েছে। ওই অপারেশনে ১৮ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কি পরবর্তী হামলাগুলিকে একেবারে আটকে ফেলা গিয়েছে? নাকি তা পরবর্তী হামলার বীজই পুঁতে রেখেছিল? সাম্প্রতিক হামাসের হামলা সেই প্রশ্নই নতুন করে তুলতে শুরু করেছে। গোটা বিশ্বজুড়ে ফের আলোচনায় উঠে আসছে ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement