স্বর্ভানু সান্যাল, শিকাগো: মনের গভীরে বাসা বেঁধেছে নিশ্চিত মৃত্যুভয়। অদৃশ্য শত্রু কখন যে দ্রুত এসে নিজের জমি দখল করে নিয়েছে তা বুঝতেও পারিনি। দোর্দণ্ডপ্রতাপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর তার নাগরিকরা অসহায়। অসহায় আমরা প্রবাসীরাও। এখন একটা অন্ধ মরণকূপ হয়ে গিয়েছে গোটা মার্কিন মুলুক। স্বপ্নের শহর শিকাগো মৃত্যু উপত্যকা।
আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা ছয় লক্ষ ছাড়িয়েছে। মৃত বেড়ে ২৮ হাজার। মর্গেও ঠাঁই নাই দশা। বহু বাড়ি থেকে সময়মতো তোলা যাচ্ছে না করোনার ছোবলে মৃত লাশও। সত্যি যে এমনটা হতে পারে স্বপ্নেও ভাবিনি। তিন সপ্তাহ আগেও প্রবাসী বাঙালিরা নিজেদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেছি, “This too shall pass”। আমাদের বাঙালি সমিতির সাংস্কৃতিক কার্যনির্বাহী হিসেবে দিন পনেরো আগেও আমরা আলোচনা করেছি বঙ্গসংস্কৃতি দিবসে স্থানীয় প্রোগ্রাম কী হবে, দেশ থেকে কোন কোন আর্টিস্ট নিয়ে আসা হবে। ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু নিয়ে মার্কিন মিডিয়া যতটা শোরগোল করেছিল শেষমেশ তা অত ক্ষতি করতে পারেনি। তাই মনে মনে কোথাও একটা দম্ভ ছিল, মানব সভ্যতা আর বিজ্ঞানের উদ্ধত জয়রথের চাকার তলায় যে কোনও আণুবীক্ষণিক জীব পিষে যাবে সহজেই। কিন্তু করোনা সেই গরিমার ফানুসে ফুটো করে দিয়ে গেল। এখন বাঙালি সমিতির সব অনুষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত। শুধু তাই নয় জন্মদিন, অন্নপ্রাশন, বিয়ের নিমন্ত্রণ কর্তারা অলরেডি ই-মেল করে জানিয়ে দিয়েছেন, অনুষ্ঠান আপাতত বাতিল। লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে ইলিনয় রাজ্যে। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, আদৌ বাঁচব তো?
গত তিন সপ্তাহ ধরে স্ত্রী-কন্যা ছাড়া অন্য কোনও মানুষের মুখ দেখিনি। শেষ গ্রোসারি গিয়েছিলাম ১৬ দিন আগে। চাল ডাল আলু ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে স্যানিটাইজার, টিস্যু পেপার নিতে গিয়ে দেখলাম, পুরো স্টক ফাঁকা। আমি দেরি করে ফেলেছি। দশ বছর মার্কিন মুলুকে বাস করছি। এই প্রথমবার দেখলাম, জুয়েল অস্কোর মতো একটা বিরাট মাপের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে নিত্যব্যবহার্য জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ি ফিরে জামাকাপড় সঙ্গে সঙ্গে লন্ড্রি মেশিনে দিয়েই স্নান করতে ছুটেছিলাম… কে জানে সঙ্গে করে করোনা এনেছি কিনা সেই ভয়ে। আর মৃত্যু তো এখন ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে। গৃহবন্দি হয়ে সারাক্ষণই মহামারীর খবরদর্শন টিভি চ্যানেলে। শিকাগো থেকে সুদূর দুর্গাপুরে নিজের বাড়িতে ফোন করে করে খোঁজ নিচ্ছি রোজ। ইচ্ছে করলেও নিজের প্রিয় মানুষগুলোর কাছে ফিরে যেতে পারব না। আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধ। আমার চার বছরের কন্যা জিজ্ঞেস করছে, “বাবা, আমরা কেন সিনেমা দেখতে যেতে পাব্বো না? ভাইলাস (ভাইরাস) কবে ফিরে যাবে?” ও এখনও আধো-আধো কথা বলে। মেয়েকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে চোখ রাখতেই দেখি আমার এক স্কুলের বন্ধু, যে নিউ ইয়র্কে থাকে, জানিয়েছে, ‘তার স্ত্রী’র করোনা ধরা পড়েছে। খুব জ্বর।’ বন্যার জলের মতো ফিরে আসে দুশ্চিন্তাগুলো। প্রশ্নটা এখন এই নয় যে আমি বা আমার পরিবার করোনা আক্রান্ত হবে কিনা। প্রশ্নটা হল, কবে হব? ততদিনে হাসপাতালগুলোর উপর চাপটা কিছু কমবে কিনা। কারণ হাসপাতালগুলোতে এখন ঠাঁই নাই অবস্থা। ভেন্টিলেশনও মিলছে না। রাস্তাঘাট জনমানবশূন্য, শিকাগোয় যেন শ্মশানের শান্তি সর্বত্র।
তবে মানুষের কোলাহল থেমে যেতেই দূষণমুক্ত প্রকৃতি তার বর্ণময় বরণডালা নিয়ে ফিরে আসছে। আমার বাড়ির লাগোয়া বাগানে ফুটে ওঠা হরজাই ফুল জানিয়ে দিচ্ছে, শীতের শেষ আর বসন্তের আগমন। আর হোয়াটসঅ্যাপ বাহিত হয়ে আসা অজস্র দুঃসংবাদের মাঝেই দু’ একটা সুখবর ভেসে আসছে। ইতালিতে এক ১০১ বছরের বৃদ্ধ করোনা জয় করে ফিরে এসেছেন সুস্থ হয়ে। মৃত্যুর হাতছানি এখন অনিবার্য নিয়তি হয়ে দেখা দিয়েছে আমেরিকায়। তারই মাঝে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরছি এসব খবর। করোনা আক্রান্ত হয়েও যাঁরা করোনাকে হারিয়ে সেরে উঠছেন তাঁদের মধ্যে মরিয়া হয়ে খোঁজার চেষ্টা করছি বাঁচার উপায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.