বিশ্বদীপ দে: ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’। হ্যাঁ, তালিবান (Taliban)। সিরফ নাম হি কাফি হ্যায়। ফের গোটা বিশ্বকে শঙ্কিত করে আফগানিস্তান (Afghanistan) দখলের পথে তারা। ইতিমধ্যেই ১৪টি প্রদেশ দখল করে ফেলেছে তালিবান। কাবুল দখল করা এখন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। আবারও এক অন্ধযুগের সূচনালগ্নে তাই ফিরে ফিরে আসছে পুরনো দিন। ফিরে আসছে তালিবানদের হাড়কাঁপানো নিষ্ঠুরতার মিথ।
গত শতাব্দীর নয়ের দশকে প্রথমবার শোনা গিয়েছিল এই শব্দটি। কী অর্থ এই নামটির? তালিবান মানে হল ‘ছাত্র’। শুনে যতই আঁতকে উঠুন, বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়ানো এই পশতু শব্দটির আসল অর্থ এটাই। বলাই বাহুল্য, সেই অর্থকে ছাপিয়ে গিয়ে আতঙ্কেরই অপর নাম হয়ে উঠেছে তালিবান। কিন্তু কেন এমন নামকরণ? আসলে এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তালিবানদের জন্মলগ্নের ইতিহাস।
আটের দশকে সোভিয়েতের দখলে থাকা আফগানিস্তানে আফগান গেরিলা বাহিনীকে শক্তিশালী করে তুলেছিল CIA। আমেরিকার মদতে তৈরি হওয়া এই ‘আফগান মুজাহিদিন’ বাহিনীকেই কার্যত ব্য়বহার করা হয়েছিল আফগানিস্তানকে সোভিয়েতের হাত থেকে মুক্ত করতে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই বাহিনীর একাংশের সঙ্গে পাকিস্তান (Pakistan) ও আফগানিস্তানের মাদ্রাসার পড়ুয়াদের যোগদানেই গড়ে উঠেছিল তালিবান।
১৯৯৪ সাল। কান্দাহার দখল করে নেয় তালিবান। সেই শুরু। দেখতে দেখতে বছর চারেকের মধ্যে প্রায় গোটা আফগানিস্তান দখলে নিয়ে ফেলে তারা। সেই সময় সাধারণ আফগান নাগরিকরা প্রসন্ন চিত্তে রীতিমতো স্বাগত জানিয়েছিল তাদের। আসলে সেই সময়ে আফগানিস্তানে চলছিল চরম অরাজকতা। দেশজুড়ে ডাকাত, ছিনতাইবাজদের দাপট। এদিকে সোভিয়েতরা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই মুজাহিদিনদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বও শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেই পরিস্থিতি থেকে একটা আপাত শান্তির বাতাবরণ তৈরি করেছিল তালিবানরা।
কিন্তু খুব বেশি সময় লাগেনি ভুল ভাঙতে। অচিরেই পরিষ্কার হয়ে যায় তাদের স্বরূপ। দেশজুড়ে শরিয়ত আইনের প্রতিষ্ঠা করে তালিবান। সেই আইনে মৃত্যুদণ্ড ছিল একেবারে মুড়ি-মুড়কির মতো ব্যাপার। ব্যাভিচারীদের প্রকাশ্যেই খুন করা হত। চুরির শাস্তি হিসেবে কেটে নেওয়া হত হাত। নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল টিভি, সিনেমা, নাচগান। জানিয়ে দেওয়া হয়, দশ বছরের বেশি বয়সি মেয়েদের জন্য স্কুলের দরজা বন্ধ। একা একা কোনও মেয়ে বাইরে বেরতে পারবে না। সব সময় কাউকে সঙ্গে করেই বেরতে হবে। পোশাক হতে হবে পুরো শরীর ঢাকা। বাধ্যতামূলক হয় বোরখা পরা। পুরুষদের জন্য দাড়ি রাখা ছিল আবশ্যক। দাড়িও হতে হবে দীর্ঘ। কেউ দাড়ি বেশি ছাঁটলেও তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হত।
১৯৯৬ সালে গোটা বিশ্ব শিউরে উঠেছিল একসঙ্গে ২২৫ জন মহিলাকে শরিয়তি নিয়ম মেনে পোশাক না পরার অপরাধে জনসমক্ষে হত্যা করার ঘটনায়। ২০০১ সালে মধ্য আফগানিস্তানে বিখ্যাত বামিয়ান বুদ্ধের মূর্তি ধ্বংস করার ঘটনায় আন্তর্জাতিক আঙিনায় তালিবানের ভয়ংকর স্বেচ্ছাচারিতা প্রকট হয়ে ওঠে। আফগানিস্তানের শাসক হিসেবে তালিবানকে মেনে নেয়নি প্রায় কোনও দেশই। কেবল পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ও সৌদি আরব ব্যতিক্রম। এদের মধ্যে পাকিস্তানকে বরাবরই তালিবানের নেপথ্য কারিগর হিসেবে দেখা হয়। যদিও পাকিস্তান এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের মাদ্রাসা থেকেই যে বিপুল পরিমাণে পড়ুয়ারা তালিবানে যোগ দিয়েছিল তা পরিষ্কার।
যাই হোক, হাতে গোনা এই দেশগুলি ছাড়া আর কেউ মেনে নেয়নি আফগান প্রশাসক তালিবানকে। কিন্তু যাবতীয় নিন্দা-সমালোচনাকে ফুৎকারে উড়িয়ে তালিবান ছিল তালিবানেই। সেই সঙ্গে ওসামা বিন লাদেনের আল কায়দা থেকে থেকে শুরু করে পাকিস্তানের নানা জঙ্গি গোষ্ঠীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল আফগানিস্তান। কিন্তু সব হিসেব উলটে গেল ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে এসে। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরে পরেই মার্কিন সেনার হানায় বেসামাল হয়ে গিয়েছিল তালিবানরা। সেদেশে আফগান সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় আমেরিকার হস্তক্ষেপে।
একবার ফের তালিবানরা ক্ষমতায় ফেরার পথে। গত মে মাসে মার্কিন সেনা সরতে শুরু করতেই ফের আফগানিস্তানে একের পর এক প্রদেশ দখল করে নিতে থাকে তালিবান। এটা যে হতে চলেছে সেটা বোঝা গিয়েছিল আগেই। ২০১৮ সালে আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা শুরু হয় তাদের। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শান্তি চুক্তি হয় দোহায়। কিন্তু সেই চুক্তির পরে এবং আলোচনা চলাকালীনও লাগাতার গোপনে হামলা চালিয়ে গিয়েছে তালিবান। মুখে অপরাধের দায় না নিলেও ওই হামলার পিছনে যে তারাই, তা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি কারও।
অবশেষে ফের আফগানিস্তান দখলের পথে তালিবানরা। আর তাদের আগমন মানেই যে ফের সেই চেনা নিষ্ঠুরতার দিনগুলির প্রত্যাবর্তন তা বুঝিয়ে দিতে শুরু করেছে তারা। আফগানিস্তানের উত্তরে বলখ প্রদেশে আটসাঁট পোশাক পরার ‘অপরাধে’ গুলি করে খুন করা হয়েছে। আত্মসমর্পণ করা ২০ জন আফগান সেনাকেও অবলীলায় গুলি করে হত্যা করেছে তালিবান জঙ্গিরা। নজর মহম্মদ নামের এক কৌতুকশিল্পীকে অপহরণ করে বেধড়ক মারধর করা হয়। তাঁর ‘অপরাধ’, মানুষকে হাসানো। তালিবানদের মতে, মানুষকে হাসানো চূড়ান্ত অপরাধ। তাই শেষ পর্যন্ত সেই হতভাগ্য মানুষটিকে মেরে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু এত কিছুর পরেও কি আফগান নাগরিকরা তালিবানকে ঘৃণা করেন? বিষয়টা কিন্তু বেশ জটিল। সামগ্রিক ভাবে হয়তো বলাই যায়, এমন পরিবেশে আমজনতা ভয়ে ভয়েই দিন কাটাচ্ছেন। মার্কিন ও ইউরোপের বহু অলাভজনক সংস্থা বিভিন্ন সময়ে সমীক্ষা চালিয়েছিল আফগান নাগরিকদের উপরে। ২০০৯ সালের এক সমীক্ষা বলছে ৫০ শতাংশ আফগান তালিবানের সমর্থক। সেটাই ২০১৯ সালে কমে এসে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশে। কিন্তু ২০২০ সালের শান্তি চুক্তির পরেই এক সমীক্ষায় ৫৫ শতাংশ আফগান জানান, তাঁরা বিশ্বাস করেন আফগানিস্তানে প্রকৃত শান্তি তালিবানরাই ফেরাতে পারবে।
এই পরিসংখ্যান থেকে প্রতিফলিত হয় আফগান নাগরিকদের মনোভাব। এত টালমাটালের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁদের যে, তাঁরা বুঝে গিয়েছেন ক্ষমতা কাঠামোকে অনুসরণ করাই শ্রেয়। তবে ভিতরে ভিতরে যে আতঙ্কের প্রহর গোনা শুরু হয়েছে তা হলফ করে বলাই যায়। হাজার হোক, তালিবান শাসনের স্মৃতি যে খুব পুরনো হয়ে যায়নি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.