কুণাল ঘোষ, সিঙ্গাপুর: সময়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলা, নাকি সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা? যা-ই বলুন না কেন, একটি নতুন থিওরি এনে শিক্ষাক্ষেত্রে ঝড় তুলে দিয়েছে সিঙ্গাপুর (Singapore)। তা হল, ‘টিচিং ফ্যাক্টরি’। চোখের সামনে দেখছি, একঝাঁক দেশ ও শিল্পসংস্থা সাগ্রহে ঝাঁপিয়েছে এই থিওরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে, থিওরি কাজে লাগাতে। সৌজন্যে নানিয়াং পলিটেকনিক, সিঙ্গাপুর। মূলত নিশ্চিত কর্মসংস্থানকে মাথায় রেখে এই নীতি, যাতে শিল্পসংস্থাও উপকৃত হয়। ‘টিচিং ফ্যাক্টরি’ মানে শিক্ষার প্রতিষ্ঠানটাকেই শিল্পমুখী পরিবেশে পরিণত করা। এক, কর্মক্ষেত্রের মতো আসল পরিবেশ। দুই, আসল আধুনিক যন্ত্রপাতি। তিন, আসল শিল্পসংস্থা থেকে আসা দক্ষ পেশাদারদের ক্লাস ও লেকচার। চার, সেই শিল্প সংক্রান্ত সমস্যাগুলো জানা ও সমাধান তৈরি করা। পাঁচ, সেই শিল্পসংক্রান্ত প্রজেক্ট তৈরি।
আগের দিন আসল হাসপাতাল আর নকল রোগীর যে বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলাম, সেটিও এই ‘টিচিং ফ্যাক্টরি’র অংশ। নানিয়াং পলিটেকনিকের (Polytechnic) সিইও ড. হেনরি হেং যত ঘুরে দেখিয়েছেন, ততই চমকে গিয়েছি। কখনও মনে হচ্ছে হাসপাতালে, কখনও মনে হচ্ছে বিরাট কারখানায় দাঁড়িয়ে আছি, কখনও মনে হচ্ছে বিজ্ঞানীর গবেষণাগারে, কখনও মনে হচ্ছে জুয়েলারি ডিজাইনারের শো-রুমে।
হেনরি বললেন, ‘‘শুধু থিওরি পড়ালে চলছিল না। কাজের সময়ে অনেক গ্যাপ। তাই টিচিং ফ্যাক্টরি কনসেপ্ট দরকার। ছাত্রছাত্রীরা থিওরির পর এই সিস্টেমে লাভবান হচ্ছে। কারণ সে আসল পরিবেশে কাজটা রপ্ত করে ফেলছে। আমরা আধুনিক যন্ত্রপাতি বসিয়ে কাজ করাই। তাতে অনেক নতুন কাজও হয়ে যাচ্ছে। আমরা ২৩৮টা পেটেন্ট পেয়ে গিয়েছি। যাঁরা ক্লাস নেন, তাঁদের মধ্যে নতুন পিএইচডি করে আসাদের থেকেও অন্তত পাঁচ বছর সংশ্লিষ্ট শিল্পে সফলভাবে কাজ করে এসেছেন, এমন ব্যক্তিদের বেশি গুরুত্ব দিই।’’
অ্যাডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং বিভাগে গিয়ে তো জ্ঞান হারানোর জোগাড়! এটা স্কুল না পুরো অত্যাধুনিক উৎপাদন কেন্দ্র? পরপর মেশিন, পেল্লায় চেহারার। বহু উৎপাদন শো-কেসে সাজানো। দাবা থেকে চশমার ফ্রেম, গয়না থেকে দরকারি জিনিসপত্র। নতুন ডিজাইন তৈরি। ডাটা আর উপাদানের কাঁচামাল মেশিনে ভরে দিলেই মেশিন যেন আশ্চর্য প্রদীপ! রাফায়েল লি বোঝালেন, ‘‘দেখুন এটা কীভাবে চিকিৎসাতেও কাজে লাগে। ওই যে দেখছেন দুটো জোড়া মাথার খুলি, ওটা নেপালের জুড়ে থাকা যমজ জঙ্গা-রঙ্গার। অপারেশনের আগে এই থ্রি ডি ইমেজ প্রিন্টিংয়ে ডাক্তাররা পরিস্থিতি বুঝেছিলেন। ভাঙা চোয়াল জোড়া থেকে বহু কৃত্রিম সূক্ষ্ম অঙ্গ বসাতেও এই সিস্টেম কাজ করে। চোয়াল, হাঁটুর অংশ দিব্যি তৈরি হচ্ছে।’’ অবাক চোখে দেখলাম আরও নানা ক্ষেত্রের নানা ডিজাইন তৈরি। চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত। থ্রিডি প্রিন্টারের কামাল। ডিরেক্টর এসথার বে বললেন, ‘‘ওই যে দেখুন, ওই ছাত্রকে প্রজেক্ট বোঝাচ্ছেন এক শিল্পসংস্থা থেকে আসা কর্তা।’’ আইটি বিভাগেও চরম ব্যস্ততা। গোপন কথাবার্তার জন্য ছোট সাউন্ড প্রুফ কাচের রুম। লি বললেন,‘‘ ওই দেখুন, নিজস্ব সার্ভার। আমরা হ্যাক করতে শেখাই যাতে হ্যাকিং প্রতিরোধের সব কৌশলে এরা দক্ষ হতে পারে।’’
এই ‘টিচিং ফ্যাক্টরি’ চিন (China) থেকে শুরু করে বহু দেশকে আকৃষ্ট করেছে। সিইও বললেন, ‘‘আমরা ট্রেনারদেরও ট্রেনিং করাই। অনলাইন হতেও পারে। তবে হ্যাঁ, এই পরিবেশটার পূর্ণ উপযোগিতা সেক্ষেত্রে পাওয়া কঠিন।’’ অ্যাস্থরের কথায়, ‘‘আমাদের পড়ুয়ারা কোর্স শেষের পর কাজ পেয়ে যায়। আমরাই সমীক্ষা করি। আসলে শিল্পকর্তারাও জেনে গিয়েছেন এখানে হাতেকলমে কাজ শেখানো হয়, যেটা সাধারণ ল্যাবের থেকেও বহুগুণ কার্যকর। আমরা তাই ল্যাব তো রেখেছি, সেই সঙ্গে আসল কাজের পরিবেশ। আপনি দেখুন, হাসপাতালের ঘরের উচ্চতার থেকে কত বেশি উঁচু আর বড় ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ঘর। আমরা ফ্যাক্টরি ফিলিংস দিয়েছি পুরোপুরি। এইসব মেশিন বসাতেও বিপুল বরাদ্দ করা হয়।’’
নানিয়াংয়ের পেল্লায় প্রাঙ্গণ। দৈর্ঘ্যে এক কিলোমিটার, প্রস্থে হাফ। চোখ ধাঁধানো ক্যাম্পাস। প্রায় চোদ্দো হাজার ছাত্রছাত্রী। বিভিন্ন দেশকে, চিন-সহ অন্তত ডজনখানেক দেশ তো বটেই, মেধাভিত্তিক সহযোগিতা দিচ্ছে নানিয়াং। সিঙ্গাপুর সরকার নিয়ন্ত্রিত নানিয়াংয়ের অন্যতম উপদেষ্টা বঙ্গতনয় প্রসূন মুখোপাধ্যায়, আপাতত সিঙ্গাপুরে না থাকায় দেখা হল না। ইউনিভার্সাল সাকসেসের এই কর্ণধার সিঙ্গাপুর-ইন্ডিয়া চেম্বার অফ কমার্সের সহ সভাপতিও বটে। নানিয়াংয়ের সহযোগিতা নেওয়ার কার্যকর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বাংলার একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভারতের একাধিক রাজ্যেও। হেনরি বললেন, ‘‘আসলে টিচিং ফ্যাক্টরি নীতি ক্লিক করা স্বাভাবিক। আমরা শুরু করলাম। গোটা বিশ্বকে এই মডেলে যেতে হবে। সাধারণ শিক্ষা নয়, একেবারে নির্দিষ্ট স্লটে সময়োপযোগী শিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করলে ছেলেমেয়েদের বসে থাকতে হবে না। স্কুল-কলেজের পর ফ্যাক্টরি নয়, ফ্যাক্টরিকেই আনতে হবে পড়ুয়ার কাছে। তখন থেকেই সংশ্লিষ্ট শিল্প সংস্থাগুলির সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে। সমস্যা ও সমাধানগুলি শিখবে। আমরা এই মডেলটা তুলে ধরছি।’’
নানিয়াংয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, ডিজিটাল মিডিয়া (Digital Media), আইটি, অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স, হেলথ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্স-সহ প্রতিটি বিভাগই চোখ ধাঁধানো। আরও কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আমিও আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। তাতে সাড়া দিয়ে নিজেরই কিছু অভিজ্ঞতা বাড়ল, সমৃদ্ধ হলাম। এত বড় পরিকাঠামো, ঝাঁচকচকে সাম্রাজ্য দেখে মুগ্ধতার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগছে এই কনসেপ্ট – টিচিং ফ্যাক্টরি। এবার বলুন এর নাম সময়ের সঙ্গে পথ চলা, নাকি সময়ের থেকেও এগিয়ে? নতুন প্রজন্মের কর্মসংস্থানের প্রশ্নে নিঃসন্দেহে এক অভিনব পরিকল্পনা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.