বিশ্বদীপ দে: স্মৃতি যেন সুতোয় বাঁধা। একটায় টান পড়লে অন্যগুলোও নড়েচড়ে উঠতে থাকে। ইতিহাসও তো স্মৃতি। কারও ব্যক্তিগত নয়, বলা যায় দেশকালের সামগ্রিক স্মৃতি। গত সোমবার সকালে মায়ানমারের (Myanmar) কাউন্সিলর (সেদেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদ) আং সান সু কি-সহ (Suu Kyi) শাসকদলের বেশ কয়েকজন নেতাকে আটক করে সেদেশের সেনাবাহিনী। সেই খবরে চোখ রাখার সঙ্গে সঙ্গে বহু মানুষেরই মন ফের ধাওয়া করেছে বার্মা মুলুককে (Burma)। সেই বার্মা, গ্রীষ্মকালে বঙ্গদেশের ভীষ্মলোচন শর্মা গান ধরলে যে তল্লাট পর্যন্ত তা পৌঁছে যেত। সুকুমার রায়ের ছড়ার মতোই শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবি’- বাঙালির সঙ্গে এক অমোঘ বন্ধন মায়ানমারের। না, মায়ানমার নয়। বার্মা। একই দেশ হলেও নামের মতোই তার চরিত্রও পালটে গিয়েছে।
বার্মার সঙ্গে বাঙালির আসল যোগসূত্র নিঃসন্দেহে সেই মানুষটি, যিনি সদ্য ১২৫তম জন্মদিনটি পেরিয়ে এলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর (Netaji Subhas Chandra Bose) আজাদ হিন্দ ফৌজের (Indian National Army) সঙ্গে বার্মার সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে বলবার কিছু নেই। তবে এটা হয়তো অনেকেরই জানা নেই, নেতাজির সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছিল বার্মার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা পুরুষ জেনারেল আং সানের (General Aung San)। হ্যাঁ, তিনিই আজকের আং সান সু কি-র বাবা। ইতিহাস এভাবেই জুড়ে রেখেছে বার্মা মুলুক ও বাঙালির এক অমোঘ কিংবদন্তিকে।
বিশিষ্ট নেতাজি গবেষক জয়ন্ত চৌধুরী জানাচ্ছেন, আং সানের সঙ্গে সুভাষের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দু’জনের একসঙ্গে ছবিও রয়েছে। আরও নানা প্রমাণ রয়েছে সেই বন্ধুত্বের। তিনের দশকের শেষ দিকে দু’জনের পরিচয় হয়েছিল। তারপর ক্রমশ গাঢ় হয় সম্পর্ক। যার প্রতিফলন পড়েছিল নেতাজির আইএনএ ও আং সানের বিএনএ (বার্মিজ ন্যাশনাল আর্মি) সেনাদের মধ্যে তৈরি হওয়া সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কেও। আরও এক জায়গায় মিলে যায় দুই বন্ধুর জীবন। দু’জনেরই জীবন শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছিল এক ট্র্যাজিক প্রান্তে। একদিকে সুভাষকে ঘিরে গড়ে ওঠা মিথের মায়াজাল। অন্যদিকে ১৯৪৭ সালে আং সানের মৃত্যু। এই ভাবেই বিষণ্ণতা ছুঁয়ে রয়েছে দুই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই ‘হিরো’র অন্তিম অধ্যায়কে।
বার্মা স্বাধীন হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। তার আগের বছরই খুন হন আং সান। দেশের স্বাধীনতার সূর্য আর দেখা হয়নি তাঁর। আসলে বার্মার ইতিহাসের সঙ্গে তাদের সেনার আগ্রাসী মনোভাবের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তাও স্বাধীনতার পরের চোদ্দো বছরে খানিক ঢাক ঢাক গুড় গুড় ছিল ব্যাপারটা। যাকে বলে ‘কোয়াসি ডেমোক্রেসি’। মানে নামমাত্র গণতন্ত্র। এরপর ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে দেশে সেনাশাসন জারি হয়। পরবর্তী সময় জুড়ে বারবার গণতন্ত্র ফেরানোর আওয়াজ উঠেছে বার্মায়। আর প্রতিবারই সেনা সেই কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। এর মধ্যে কেবল ১৯৮৮ সালেই আন্দোলনের টুঁটি টিপে ধরতে অন্তত পাঁচ হাজার আন্দোলনকারীকে মেরে ফেলে সর্বশক্তিমান সামরিক ‘জুন্টা’।
তবুও সু কি’র উত্থানকে রোখা যায়নি। ২০১৫ সালে তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মসনদে বসেন। অবশেষে ফের তাঁকে আটক করে ক্ষমতা কার্যত পুনর্দখল করল সেনা। যাই হোক, আবার পুরনো কথায় ফিরি। আসলে প্রথম থেকেই সেনার ভয় ছিল, জাতীয় নায়ক বাবার মেয়ে হিসেবে প্রবল ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেন সু কি। তাই আং সানকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানের ছিটেফোঁটাও দেওয়া হয়নি। মায়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গৌরবময় অধ্যায়কে এভাবেই কালো চাদরে মুড়ে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। আর তার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই আইএনএ’র ইতিহাসকেও বেলজার চাপা পড়তে হয়েছে।
ধরা যাক, আপনি বেড়াতে গেলেন একদা বাঙালির প্রাণের বার্মা মুলুকে। কিন্তু আজকের মায়ানমারে স্বাধীনতা-পূর্ব সমযের সেই ইতিহাসকে সহজে খুঁজে পাবেন না। রেঙ্গুন, যার বর্তমান নাম ইয়াঙ্গন, সেখানেই রয়েছে আইএনএ’র বিল্ডিং। রয়েছে আরও নানা স্মৃতিসৌধ। কিন্তু সেসব খুঁজতে আপনাকে মোটেই সাহায্য করতে রাজি হবেন না কেউ। হাস্যমুখ হোটেল ম্যানেজার উদাসীন হয়ে যাবেন মুহূর্তে। ইয়াঙ্গনের রেল স্টেশনের একেবারে কাছেই ছিল আইএনএ’র সদর দপ্তর। আজও রয়েছে সেই রোমাঞ্চকর ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু আপনি যদি কাউকে জিজ্ঞেস করেন, লক্ষ করবেন লোকজন এড়িয়ে যাচ্ছে বিষয়টি। আসলে সেনার চর দেশের সর্বত্র ছড়ানো। যার ফলশ্রুতি এই আশ্চর্য নীরবতা।
আজ থেকে বছর ছয়েক আগে যখন সু কি ক্ষমতায় আসেন, তখন আশা জেগেছিল। মায়ানমারের মাটিতে থাকা সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজের সেই আশ্চর্য সংগ্রামের স্মৃতিচিহ্নগুলি এবার হয়তো ঠিকঠাক রক্ষিত হবে। কিন্তু ফের সেনা অভ্যুত্থানে সেই আশার উপরে জেগে থাকা আলোকবৃত্ত আবারও যেন মুছে গেল। তবে ইতিহাসের লাইটহাউসকে এত সহজে নষ্ট করবে কে? বাঙালির প্রাণের ‘সুভাষ ঘরে ফেরে নাই’। কিন্তু সারা পৃথিবীর নানা প্রান্ত জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সেই নায়কের জয়গাথা। বার্মা যার অন্যতম ভরকেন্দ্র। সেই ইতিহাস, সেই সংগ্রামের সঙ্গে আং সানের যোগসূত্রও এক অমোঘ জলছাপের মতো। ইতিহাসমুখী মানুষের হৃদয় থেকে সেই স্মৃতিসৌধকে মোছার ক্ষমতা কারও নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.