মৈনাক মণ্ডল: ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ এবং তাঁর এলটিটিই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বছর দশেক আগে। ২০০৯ সালের পর ২০১৯। এই দশ বছরে একবারের জন্যও জঙ্গি হামলা, বিস্ফোরণ, রক্তপাত দেখেনি শ্রীলঙ্কা। মোটামুটি ছোটখাটো ঘটনা ছাড়া শান্তিতেই কাটছিল সিংহলিদের জীবন। বলা ভাল, দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে চলা তামিল বনাম সিংহলিদের গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দ্বীপরাষ্ট্রের মানুষ যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। বাতাসে বারুদের গন্ধ উবে গিয়েছিল। টাটকা বাতাসে ছিল শান্তির সুবাস। কিন্তু বিধি বাম। দশ বছরের মধ্যেই সন্ত্রাস ফিরল নীলকান্তমণি, দারুচিনির দ্বীপে।
[আরও পড়ুন:হামলার আগাম সতর্কবার্তা ছিল, ভয়াবহ নাশকতার পর স্বীকার শ্রীলঙ্কা পুলিশের]
ইস্টার সানডে-র ভয়াবহ হামলার পর দুনিয়া জুড়ে তাবড় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি নড়েচড়ে বসেছে। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল, এলটিটিই হয়তো পূর্ণ শক্তি নিয়ে ফিরে এল। কিন্তু তামিল টাইগারদের পূর্ণ শক্তিতে ফিরে আসা খুব কঠিন। কারণ এখনকার পরিস্থিতি ও শর্ত তামিলদের ইলম (স্বাধীন দেশ) গঠনের পক্ষে মোটেই সহায়ক নয়। ভারত সরকার তাদের শত্রু। এলটিটিই-র গুরুত্বই হারিয়ে গিয়েছে তাদের প্রবল সমর্থক তিনটি ভারতীয় রাজনৈতিক দলের কাছে। এই তিনটি দল হল, ডিএমকে, এমডিএমকে, শিবসেনা। তাছাড়া তামিলনাড়ু ও শ্রীলঙ্কার তামিলদের একটি প্রজন্মের মন থেকেই মুছে গিয়েছে তারা। বিশ্বের ‘একমাত্র ভয়ঙ্কর হিন্দু জঙ্গি সংগঠন’টি লুপ্ত অনেক আগেই। এরাই একমাত্র জঙ্গি সংগঠন ছিল যারা ভগবান শিবের উপাসক এবং এরাই এশিয়ায় ‘মানববোমা’র অস্ত্রটি দুর্দান্তভাবে কাজে লাগাত। টাইগারদের দেখেই অস্ত্রটি ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে শুরু করে আল কায়দা, হামাস, হিজবুল্লা, জইশ-ই-মহম্মদ।
এলটিটিই-র সর্বাধিনায়ক প্রভাকরণ ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্রের অন্ধভক্ত এবং উলফা প্রধান ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী নেতা পরেশ বড়ুয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ২০০৯ সালে এক মাস ধরে যুদ্ধ চলেছিল। রসদ ও অস্ত্রহীন প্রভাকরণকে জাফনায় কোণঠাসা করে মারে শ্রীলঙ্কার সেনারা। তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকেও গুলি করে মারা হয়। কিন্তু গত দশ বছরে শ্রীলঙ্কার ‘জন-মানচিত্র’ অনেকটাই বদলেছে। সংখ্যালঘু হিন্দু তামিলদের সঙ্গে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের শত্রুতা এখন অতীত। এখন শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ও সমাজে বড় সমস্যা হল সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের সঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বেড়ে চলা শত্রুতা ও হিংসা। গত ছ’ বছরে বিক্ষিপ্তভাবে ঘটতে থাকা বৌদ্ধ-মুসলিম সাম্প্রদায়িক হিংসায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রান্তিক জেলা ও গ্রামগুলির বাসিন্দা মুসলিমদের। এখানকার সমস্যার সঙ্গে হুবহু মিল আছে মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যার। দুই দেশেই বৌদ্ধরা সংখ্যাগুরু। দুই দেশেই বৌদ্ধরা আর্থিক সামাজিকভাবে ক্ষমতাশালী। সংখ্যালঘু কোণঠাসা রোহিঙ্গারা মায়ানমারে এবং সিংহলি মুসলিমরা শ্রীলঙ্কায় অস্ত্র হাতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চালাচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় মুসলিমরা চিনের জিনজিয়াং প্রদেশের বা মায়ানমারের আরাকানের মুসলিমদের মতো এতটা সংঘবদ্ধ না হলেও তাদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন’ দানা বাঁধছে। তা যথারীতি জেহাদের আকার নিচ্ছে। তাতে থাকছে সেই খিলাফতের মোহ।
খিলাফত অর্থাৎ ইসলামের নামে সাম্রাজ্য তৈরির আকর্ষণ যেখানে অ-মুসলমানদের কোনও জায়গাই থাকবে না। শ্রীলঙ্কায় এই কাজটা করছে এনটিজে (ন্যাশনাল তৌহিদ জামাত)। শ্রীলঙ্কা গোয়েন্দাদের দাবি, এরা হল ইসলামিক স্টেটের ছায়া সংগঠন। এরাই দ্বীপরাষ্ট্রে খিলাফত আমদানি করেছে। এরাই হল এলটিটিই-র নব্য উত্তরসূরি। জাহারান হাশিম, আবু মহম্মদ নামে দুই ফিদায়েঁ (আত্মঘাতী জঙ্গি) গির্জায় হামলা চালিয়েছে। তবে জঙ্গিহানার একটি ‘স্ট্রাটেজিক টার্গেট’ ‘ভারতীয় দূতাবাস’ কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকায়, তা ব্যর্থ হয়েছে। ফলে জঙ্গিদের পিছনে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর হাতও থাকতে পারে। সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.