সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: দীর্ঘ সাত দশক ধরে তিনি দেশ চালিয়েছেন। বৃহস্পতিবার গোটা বিশ্বকে স্তব্ধ করে চলে গিয়েছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তাঁর প্রয়াণে রাজ ঐতিহ্য অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে। রানি-বন্দনা হচ্ছে, তাঁর গৌরবগাথা নিয়ে চর্চা হচ্ছে, সেই সঙ্গে কিন্তু আলোচনায় উঠে আসছে রাজপরিবারের অস্বস্তির কথাও। যুবরানি ডায়না রাজপরিবারের গোঁড়ামি ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন। বিয়ের পরেও চার্লসের সঙ্গে পার্কার বোলসের সম্পর্ক ডায়নাকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। সর্বসমক্ষে বলেছিলেন, এই প্রেমহীন জীবন তাঁর না পসন্দ। শুধু চার্লস-ডায়না এবং রানির সম্পর্কের অবনতি নয়, আরও একাধিক সমস্যায় দীর্ণ হয়েছিল রাজপরিবার। সেগুলোতেই আরও একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
যুবরানি ডায়না, যুবরাজ চার্লস এবং ‘তৃতীয় সেই ব্যক্তি’
১৯৮১ সাল। ব্রিটেন (Britain) জুড়ে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। বিয়ের পিঁড়িতে বসেন বিশ্বের ‘মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলর’ প্রিন্স চার্লস। রাজবধূ হয়ে আসেন অভিজাত বংশের সুন্দরী ডায়না স্পেনসার। ‘প্রিন্সেস ও ওয়েলস’-এর ভূমিকায় তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে ব্রিটিশ জনতা। কিন্তু সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে সময়ের সঙ্গে। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ও মানসিক অত্যাচারের অভিযোগ পালটা অভিযোগে ৯২ সালে আইনত বিয়ে ভেঙে দেন ডায়না ও চার্লস। ১৯৯৫ সালে বিবিসি-র সাংবাদিক মার্টিন বশিরকে দেওয়া এক বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে ডায়না বলেন, “ওই বিয়েতে আসলে আমরা তিনজন ছিলাম। তাই জায়গা কম ছিল।” সহজ কথায়, চার্লস ও ক্যামিলা পার্কার বোলসের মধ্যে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন ডায়না। শুধু তাই নয়, জেমস হিউইট নামের নিজের এক প্রশিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্কের কথাও স্বীকার করেন তিনি। ডোডি আল-ফায়াদের সঙ্গে ডায়নার সম্পর্কের কথাও বহুল প্রচলিত। এহেন স্ক্যান্ডাল প্রকাশ্যে আশায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন রানি এলিজাবেথ।
বলে রাখা ভাল, ১৯৯৭ সালে প্যারিসে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ডায়নার। তারপর ২০০৫ সালে ক্যামিলাকে বিয়ে করেন চার্লস। ডায়নার প্রতি বিশেষ ভালবাসা না থাকলেও মন থেকে এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি রানি এলিজাবেথ।
রাজকুমারী অ্যানের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের কন্যা রাজকুমারী অ্যান। বিখ্যাত অলিম্পিয়ান মার্ক ফিলিপের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। কিন্তু সেই সম্পর্ক সুখের ছিল না। প্রায় বিশ বছরের দাম্পত্যে ছেদ টেনে ১৯৯২ সালে তাঁদের ডিভোর্স হয়। এক ব্রিটিশ পত্রিকায় সেই বিয়েকে ‘অনন্দহীন নাটক’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। তারপরই সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায় অ্যানের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কথা। প্রকাশ পায় প্রাসাদে নিযুক্ত নৌসেনা কর্মী টিমোথি লরেন্সকে লেখা অ্যানের ‘যৌনগন্ধী’ একাধিক চিঠি। এই কেলেঙ্কারির ফলেও ব্রিটিশ রাজপরিবারকে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়।
প্রিন্স হ্যারির ভেগাস অ্যাডভেঞ্চার
ছোটবেলা থেকেই প্রথা ভাঙার দিকে ঝোঁক ছিল প্রিন্স হ্যারির। রাজপরিবারের সেই আদব-কায়দা যেন বড় বেশি ভারী ঠেকছিল তাঁর কাছে। ২০ বছর বয়সে এক পার্টিতে নাৎসি পোশাক পরে বিতর্ক উসকে দিয়েছিলেন তিনি। যদিও পড়ে তাঁর এহেন ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেন হ্যারি। ২০১২ সালে ফের একবার বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। লাস ভেগাসে ফুর্তির জোয়ারে ভাসতে দেখা যায় তাঁকে। ছড়িয়ে পড়ে রাজকুমারের নগ্ন ছবি। ব্রিটিশ সেনার সদস্য হিসেবে আফগানিস্তানে যাওয়ার আগে ঘটা এই ঘটনায় রীতিমতো ধাক্কা খান ডিউক অফ সাসেক্স হ্যারি। তাঁর কথায়, “দিনের শেষে হয়তো আমি নিজেকে অনেকটাই নামিয়ে এনেছি। আমার পরিবারের সমান ক্ষুণ্ণ করেছি। তবে আমার মনে হয়, রাজকুমারের থেকে বেশি করে সৈনিকের মনোভাব এসে যাওয়ায় এমনটা হয়ে গিয়েছে।”
আফগান যুদ্ধের আবহে এই ঘটনায় ব্রিটিশ জনতার মধ্যে যে সমালোচনার ঝড় উঠেছিলতার আঁচ অনেকটাই পৌঁছে গিয়েছিল বাকিংহাম প্যালেসে।
হ্যারি-মেগানের বিদ্রোহ
ব্রিটিশ রাজপরিবারে হ্যারি-মেগানের বিয়ে ছিল কার্যত ‘খোলা হাওয়ার’ প্রবেশ। কারণ, মেগানের শরীরে ছিল না রাজ-রক্ত। তদুপরি তিনি ছিলেন ডিভোর্সি মার্কিন অভিনেত্রী। তাই হ্যারির এহেন সাহসী পসক্ষেপে অনেকেই মনে করেছিলেন, এবার কিছুটা সংস্কার মুক্ত হবে রক্ষণশীল রাজপরিবার। ঐতিহ্য ও রাজকীয় আচার আচরণের লৌহ শৃঙ্খলের আবদ্ধ পরিবেশ হয়তো স্বাভাবিক হবে। কিন্তু তা হয়নি। নতুন প্রজন্মের এই বিদ্রোহী মনোভাব মেনে নিতে পারেননি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সাংসারিক বিবাদ এতটাই জটিল হয়ে ওঠে যে ২০২০ সালে রাজ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করেন হ্যারি-মেগান। যা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে ‘মেগজিট’ নাম পায়।
২০২১ সালে ওফ্রা উইনফ্রে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একের পর এক বিস্ফোরক অভিযোগ করেন হ্যারি ও মেগান। রাজবধূ মেগান বলেন, এক সময় তিনি এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিলেন, আত্মহত্যার কথাও মাথায় এসেছিল। কেবল মেগানই নন, রাজপুত্র হ্যারিও (Prince Harry) বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি নিয়ে মুখ খোলেন। বিখ্যাত সাংবাদিক ওফ্রা উইনফ্রে-কে দেওয়া ওই বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে কার্যত তোলপাড় হয় ব্রিটেন।
রাজপরিবার থেকে রাজকুমার অ্যান্ড্রুর নির্বাসন
ব্রিটিশ রাজপরিবারের স্ক্যান্ডালগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজকুমার অ্যান্ড্রুর নির্বাসন। যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে যৌন শোষণের অভিজগ আনেন সমাজকর্মী ভার্জিনিয়া জুফরে। তিনি দাবি করেন, নাবালিকা থাকা সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে জোর করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন অ্যান্ড্রু। শুধু তাই নয়, অ্যান্ড্রু ও তাঁর বন্ধু জেফরি এপস্টেইন তাঁকে ‘যৌনদাসী’ করে রেখেছিলেন বলেও বিস্ফোরক অভিযোগ করেন ভার্জিনিয়া।
এদিকে, বিতর্কের ঝড় না থামতেই মার্কিন ধনকুবের এবং নাবালিকা পাচার ও ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্ত এপস্টেইনের সমর্থনে মুখ খোলেন অ্যান্ড্রু। ফলে শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। প্রবল জনরোষের মুখে পড়েন তিনি। ২০২২ সালে মামলা চলাকালীন রাজপরিবারের অদস্য হিসেবে অ্যান্ড্রুর সমস্ত অধিকার ও সামরিক সম্মান কেড়ে নেওয়া হয়। নিজের নামের সঙ্গে আর ‘হিজ রয়েল হাইনেস’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে পারবেন না তিনি বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়। ছেলের এহেন কীর্তি রীতিমতো নাড়া দিয়েছিলে রানি এলিজাবেথকে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.