কৃষ্ণকুমার দাস: আচমকা আকাশ কাঁপিয়ে গ্রেনেডের বিকট আওয়াজ। শুরু হয়ে গেল ভয়ানক গুলির লড়াই। চিৎকার ও হই-হুল্লোড়। চারপাশের বাড়িতে আগুন-বারুদের গন্ধে এলাকায় ভয়ানক ত্রাস ছড়িয়ে পড়ল। আমরা সবাই দোকান বন্ধ করে পাশের স্কুল বাড়ির ছাদে উঠে পড়লাম। ঘণ্টাখানেক ধরে কাঠের লায়সং ব্রিজের উপর গুলির লড়াই চলল। শান্ত হতেই দেখলাম, রাইফেল-স্টেনগান উঁচিয়ে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসছে মাথায় কালো ফেট্টি বাঁধা জনা পঞ্চাশ জঙ্গি। হাতে রক্ত ঝরতে থাকা বার্মিজ পুলিশের গুটিকয় কাটা মুণ্ডু। এক নিঃশ্বাসে মংডুর চিকনছাড়িতে ১০ বার্মিজ পুলিশকে নৃশংসভাবে হত্যার সেদিনের ভয়ানক দৃশ্যের বর্ণনা দিচ্ছিলেন ষাটোর্ধ্ব সুরধন পাল।
[চাকরির টোপ দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নামানো হচ্ছে দেহ ব্যবসায়!]
কলকাতা থেকে কক্সবাজার আসার আগে জানতাম শুধুমাত্র রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী বৌদ্ধপ্রধান মায়নমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশ ছেড়েছেন দলে দলে। বাংলাদেশ সরকারের তরফে সীমান্ত পুরোপুরি খুলে দিয়ে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার অন্যতম কারণও মানবিকতার পাশাপাশি মুসলিম জনজাতির উপর অত্যাচার। কিন্তু কক্সবাজার শহর থেকে ৬০ কিমি দূরের কুতুপালং উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে পশ্চিমপাড়ার শরনার্থী শিবিরে সেই ভুল ভাঙল। সুরধন পাল, বিজয়রাম পাল, অনিমেষ বিশ্বাসদের পরিবারের সঙ্গে দেখা হতেই জানতে পারলাম, রোহিঙ্গা জঙ্গিদের ভয়াবহ সন্ত্রাস ও তাণ্ডবের কাহিনি। স্পষ্ট উপলব্ধি হল, বার্মিজ সেনা নয়, জঙ্গিদের হাতেও প্রাণ হারানোর ভয়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে হাজারের বেশি হিন্দু রোহিঙ্গা। এর মধ্যে পশ্চিমপাড়াতেই একটি পরিত্যক্ত মুরগির খামারে একসঙ্গে গাদাগাদি করে রয়েছে ৮০টি সনাতন ধর্মাম্বলম্বী পরিবার। তবে নিরাপত্তার আশ্বাস পেলে ফিরে গিয়ে চাষবাস করায় মন দিতে চান দেশচু্যত এই সমস্ত হিন্দু রোহিঙ্গারা।
“প্রথম প্রথম একদিন অন্তর হিন্দুদের ক্যাম্পে ত্রাণ আসছিল এখন সাত-দশ দিন পর পর খাবার আসছে। কিন্তু জ্বালানি নেই, চাল-গম রান্না করব কী দিয়ে? খুবই কষ্টে আছি, আপনারা কি কিছু ব্যবস্থা করে দিতে পারেন” চাটগাইয়া বাংলায় প্রশ্ন করেন শিশুদের স্নানে ব্যস্ত থাকা বীণাবালা পাল।
রাখাইনের মংডুর চিকনছড়ি বাজারে জাঁকজমক করে দুর্গাপুজো হত। দোল ও রাসপূর্ণিমায় রাধাগোবিন্দর পুজো হয়, চলত নগরসংকীর্তন। পুজো করতে কক্সবাজারের উখিয়ায় ১১ বছর আগে তৈরি শরণার্থী শিবির থেকে যেতেন এক ব্রাহ্মণ। তিনিই এবার রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীর ঢল কুতুপালং, বালুখালি ও উনছিপ্রাং এলাকায় আসার পর একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। পশ্চিমপাড়ার শিবিরে বসে ব্রাহ্মণের সেই বিশ্বজুড়ে আলোড়ন ফেলে দেওয়ার নেপথ্যের বোমা ফাটানোর ঘটনা বললেন বিজয়রাম। বললেন, “ব্রাহ্মণ যেহেতু পুজো করতে যেতেন, তাই উনি গ্রামের অধিকাংশ মহিলাকে চেনেন। আচমকা শিবিরে দেখতে পান, দু’দুজন হিন্দু বিবাহিত যুবতী শাখা-সিঁদুর ছাড়াই মুসলিম পরিবারের সঙ্গে রয়েছেন।” ওই দুই মহিলার স্বামী-সন্তানদের হত্যা করে নিজেদের সঙ্গে জোর করে নিয়ে এসেছে ‘আল—ই—খাইন’ জঙ্গিরা। শীঘ্রই ওদের বিয়ে করা হবে বলেও জঙ্গিরা হুমকি দিয়েছিল বলে পরে জানিয়েছিলেন বলে পাশ থেকে দাবি করেন গৃহবধু উলুবালা পাল। উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ পরিচালনা করা মার্কিন সংস্থার তরফে ওই দুই মহিলাকে উদ্ধার করা হয়। এমনই এক মহিলা চেকপোস্ট পেরিয়ে মায়ানমার গিয়ে ৮৬ জন হিন্দুর গণকবর শনাক্ত করে বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন।
কিন্তু কেন এমন নির্মম অমানবিক অসহিষ্ণু অত্যাচার? সবই কি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মায়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর নির্মমতা? প্রশ্ন দু’টো শেষ করতে দেন না মংডুর ১০ একর জমির মালিক পালগোষ্ঠীর কুলপতি সুরধন। কিছুটা প্রতিবাদী ঢঙে পাল্টা প্রশ্ন করেন, “এক হাতে তালি বাজে? বাজে না। ‘আল-ই-খাইন’ জঙ্গিরা গত বছর পুজোর সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে পুলিশ ও সেনা খুন করছিল। তারই জবাব এতদিনে দিতে শুরু করেছে বার্মিজ সরকার।” কিন্তু মায়ানমার সরকার তো এখন হিন্দু শরণার্থীদের দেশে ফিরতে বলছেন। কথাটা শুনে যেন একটু থমকে যান সুরধন। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, থামিয়ে দিলেন বিজয়রাম। বললেন,“কাকা, যে দৃশ্য দেখেছেন তা নিয়ে এখনও আতঙ্কে আছেন।”
[প্রাক্তনের দেওয়া উপহার বিক্রি করে প্রেম ভুলছেন ‘দেবদাস’রা]
দেশছাড়ার নেপথ্যের রোমহর্ষক কাহিনি বলতে গিয়ে শোনালেন এক সহৃদয় রোহিঙ্গা জঙ্গি পরিবারের গৃহবধূর কথা। নাম তাঁর জুননি। তাঁর জন্যই যে চিকনছড়ির ১৪৫টি হিন্দু পরিবার প্রাণে বেচেঁ গিয়েছে সেকথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জানালেন শরণার্থীরা। উলুবালার বান্ধবী, একই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন জুননি। দশ বার্মিজ পুলিশের মুন্ডু কেটে ‘আল—ই—খাইন’রা উল্লাস করার পাঁচদিন পরেও গভীর আতঙ্কে থাকলেও বাড়ি ছাড়েননি হিন্দুরা। ষষ্ঠদিন রাতে দীর্ঘ কাশফুলের খেত পেরিয়ে অন্ধকারে পালবাড়িতে এসে হাজির হন জুননি। বলেন, “আমাদের বাড়িতেই মিটিং হচ্ছে আল-ই-খাইনদের। তোমরা যেহেতু অনেকেই বাজারে ও স্কুলের ছাদ থেকে পুলিশ খুনের দৃশ্য দেখেছ তাই সাক্ষীদের বাঁচিয়ে রাখবে না ওরা। কালই সবাইকে নিয়ে গিয়ে ব্রিজের উপর রেখে জবাই করবে।” একথা শোনার আধঘণ্টার মধ্যেই ঘরে যা টাকাপয়সা ও সম্পদ ছিল তা নিয়েই দেশছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন চিকনছাড়ির হিন্দুরা। যে সমস্ত জঙ্গি সেদিন হত্যার ছক কষেছিল তারা অনেকেই এখন টেকনাফ ও উখিয়ার শরনার্থী শিবিরে আত্মগোপন করে আছে। বস্তুত এই কারণে এখনও বাইরে যেতে ভয় পান পশ্চিমপাড়ার মুরগির খামারে আশ্রয় নেওয়া হিন্দুরা। আতঙ্কের কারণকে অবশ্য বেশি গুরুত্ব দিয়েই শিবিরের মুখেই বাংলাদেশ সরকার সেনা ও পুলিশ দুই মোতায়েন করেছে। ফেরার পথে দেখা পুলিশ চেকপোস্টে দায়িত্বে থাকা অফিসারের সঙ্গে। নাম তাঁর সাফল্য রায়। প্রশ্ন তাঁর, “দাদা, আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, এরা সবাই কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন?”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.