সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: দাউ দাউ করে জ্বলছে গির্জার ছাদ। লেলিহান শিখার সঙ্গে গলগল করে বেরিয়ে আসছে ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলী। গির্জার মাথাটা কার্যত আর দেখাই যাচ্ছে না। ধোঁয়ার চাদরে ঢেকে গিয়েছে আকাশ-বাতাস। সোমবার বিকেলে মধ্য প্যারিসের জনাকীর্ণ রাস্তায় হঠাৎই এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখে কার্যত হতবাক হয়ে যান পথচারীরা। মুহূর্তের মধ্যে ভিড় জমে যায় ৮৫০ বছরের পুরনো এই গির্জার আশপাশে। খবর ছড়িয়ে যায়, আগুন লেগেছে প্যারিসে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র, বিশ্বপ্রসিদ্ধ নোতর দাম গির্জায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত শেয়ার হতে থাকে আগুনের ভয়াবহ ছবি ও ভিডিও।
আর ঠিক তখনই গোচরে আসে ‘১৫ এপ্রিল’ তারিখের বিভীষিকা! কারণ, আগেরদিন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ঠিক এই তারিখেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। সালটা ছিল ১৮৬৫। আবার ১৯১২ সালের ঠিক এই ১৪ আর ১৫ এপ্রিলেই আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবেছিল বিশ্ববিখ্যাত প্রমোদতরী টাইটানিক। তার ঠিক ১০৭ বছর পর, ২০১৯ সালে ঠিক এই দিনেই আগুনে ভস্মীভূত হল ঐতিহাসিক নোতর দাম গির্জা। প্যারিসের সবচেয়ে প্রাচীন ও বিখ্যাত নোতর দাম গির্জা দীর্ঘকাল শহরের সবথেকে উঁচু বিল্ডিং হিসেবেও পরিচিত ছিল।
সোমবার দুপুরে সেই বিখ্যাত গির্জায় আগুন লাগার খবর পেয়েই দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় দমকল। গির্জার ভিতরে কেউ আটকে পড়েছেন কিনা, দেখতে তড়িঘড়ি শুরু হয় উদ্ধারকাজ। মঙ্গলবার ভোরের দিকে দমকল ও উদ্ধারকারী দলের চেষ্টায় আগুন যখন নিয়ন্ত্রণে আসে ততক্ষণে ভেঙে পড়েছে গির্জার চূড়া ও ছাদ। পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে ছাদ-লাগোয়া কাঠের পাটাতনগুলিও। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গির্জার ভিতরের দেওয়ালে থাকা বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপত্যকীর্তিও। আগুন নেভাতে গিয়ে গুরুতর জখম হয়েছেন এক দমকলকর্মীও। তবে প্রায় ১০০জন দমকল কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রমে রক্ষা পেয়েছে ভিক্টর হুগোর ‘হাঞ্চব্যাক অব নোতর দাম’ উপন্যাসে উল্লেখিত বিশাল ঘণ্টা ঝোলানো টাওয়ারদুটি। গির্জার ভিতরে থাকা পোড়ামাটির মুখোশের কাজ। ক্রাউন অফ থ্রোন-সহ ঐতিহাসিক সব হাতের কাজ।
১৮৩১ সালের ১৬ মার্চ যখন বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগোর উপন্যাস ‘হাঞ্চব্যাক অব নোতর দাম’ প্রকাশিত হচ্ছে, সেসময়ই প্যারিসের বিখ্যাত নোতর দাম গির্জা বিশ্বের দরবারে পরিচিতি পায় ।১৩৪৫ সালে এই গির্জা বানানোর কাজটি সমাপ্ত হয়। যা বানানোর প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল, তার ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে। রাজা লুই-এর আমলে। ১১৬৩ খ্রিস্টাব্দে। ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে বানানো এই বিশাল ঐতিহ্যমণ্ডিত গির্জাটি প্রকৃত অর্থেই পৃথিবীর স্থাপত্যের ইতিহাসের এক অনিবার্য দলিল। যদিও শতকের পর শতক ধরে বহু বিপদের সম্মুখীন হয়েছে ৬৯ মিটার বা ২২৬ ফুট উচ্চতার এই গির্জাকে। ফরাসি বিপ্লবের সময় ১৭৯০ সাল নাগাদ এই গির্জার ভিতরে থাকা বহু স্থাপত্য ও চারুকলা একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ফরাসি ‘গথিক’ স্থাপত্য-কীর্তির অন্যতম আকর্ষণীয় নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয় এই গির্জাকে। প্রতি বছর অন্তত ১.৩ কোটি মানুষ এই গির্জা দেখতে আসেন। স্বাভাবিকভাবেই বহু ইতিহাসের সাক্ষী, প্রাচীন এই ক্যাথোলিক গির্জায় আগুন লাগার খবরে শোকস্তব্ধ গোটা বিশ্ব। মন খারাপের পাশাপাশি উদ্বেগ এবং আতঙ্কও ছড়িয়ে পড়েছে সব মহলে।
কিন্তু ঠিক কী কারণে ঘটল এই দুর্ঘটনা? দমকল সূত্রে দাবি, গির্জার সংস্কার চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। সেই কাজ চলাকালীনই কোনওভাবে আগুন লেগে যায়। তবে আগুনের খবর পাওয়া মাত্রই পুলিশের তরফে টুইট করে সবাইকে সতর্ক করা হয়। স্থানীয়দের উপদ্রুত এলাকা থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি আশপাশের ঘরবাড়িগুলিও খালি করে দেওয়া হয়। আগুনের খবর পেয়ে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে ঘটনাস্থলে ছুটে যান ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। তারপর পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে বলেন, “নোতর দাম আমাদের ইতিহাস, আমাদের সাহিত্য, আমাদের অহংকার। আজ গোটা দেশ আবেগে-শোকে বাকরুদ্ধ! তবে নোতর দাম গির্জা আমরা ফের তৈরি করব।” টুইট করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। তাঁর কথায়, “ভয়ংকর আগুন নোতর দাম গির্জায়! ভয়াবহতা দেখে মনে হচ্ছে উড়ন্ত জলের ট্যাংকার না আনা পর্যন্ত এ আগুন নেভানো অসম্ভব। যা করবেন, দ্রুত করবেন।”
Notre Dame spire collapses as fire rages at iconic paris cathedral #NotreDame #paris #notredame pic.twitter.com/1UKrmVnSTA
— Joel (@joelidentity) April 16, 2019
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.