Advertisement
Advertisement

Breaking News

‘কাফের বলেই ধর্ষণ করা হত আমাদের’

'একটা মোটা মতো লোক আমাকে এসে চেপে ধরল। হিঁচড়ে নিয়ে গেল সিঁড়ির তলায়।'

Nadia Murad reveals ISIS horror to BBC
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:October 6, 2018 10:02 am
  • Updated:October 6, 2018 10:47 am  

২০১৬-র ২৯ ফেব্রুয়ারি নাদিয়া মুরাদ-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সারা মন্তেগু ‘বিবিসি হার্ডটক’-এর জন্য। শুক্রবার নাদিয়ার নোবেলপ্রাপ্তির সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই সেই ইন্টারভিউটি নতুন করে নেটে আপলোড করে বিবিসি। সেই ইন্টারভিউয়ের অংশবিশেষ সংক্ষেপে অনুবাদ করা হল। বিশেষ সৌজন্য বিবিসি

সারা: আইএসের আক্রমণ নেমে আসার আগে তোমার জীবন কেমন ছিল বলবে?

Advertisement

নাদিয়া: বাকিদের যেমন হয়, আমারও তাই। ছাপোষা। সাধারণ মাটির বাড়ি। তবে হাসিখুশির আবহ আমাদের গ্রামটাকে সাজিয়ে রাখত। মহল্লায় কারও সঙ্গে কারও মনোমালিন্য ছিল না। আঠেরো মাস আগে, মানে আইএস হামলা চালানোর আগের কথা বলছি, সব ঠিকঠাকই ছিল, তারপর কী যে হয়ে গেল সহসা!

সারা: উগ্রপন্থীদের অনুপ্রবেশের পর কী কী ঘটতে শুরু করে?

নাদিয়া: সালটা ২০১৪। ৩ আগস্ট। ‘দায়েশ’ আমাদের শিঞ্জর গ্রামে ইয়াজিদিদের উপর আক্রমণ করে। এর আগে, ওরা ইরাকের তাল আফার আর মসুলে হানা দেয়। শিয়া আর খ্রিস্টানদের ধরে ধরে বের করে। দুটো শর্ত ছুড়ে দিয়েছিল সামনে– হয় ঘর ছাড়ো, নয়তো টাকা ফেলো খাজনা স্বরূপ। অধিকাংশ মানুষই বেরিয়ে পড়ে চুপচাপ। শিঞ্জরে হানা দিয়ে কিশোর-যুবক থেকে শুরু করে প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ, প্রায় ৩০০০ জন পুরুষকে ওরা ঠান্ডা মাথায় খুন করে। আটক করে শিশু ও বৃদ্ধাদের। আমাদের গ্রাম পাহাড়ের থেকে দূরে ছিল। আমরা আর পালাতে পারলাম না, দায়েশরা আমাদের ধরে নেয়। পুরো দলছুট আর কোণঠাসা হয়ে যাই আমরা। পরের কয়েক দিন ওরা গ্রাম ঘিরে থাকে। কেউ বেরতে পারিনি। আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, ভয়ংকর কিছু একটা হতে চলেছে। আমরা নেট, ফোন সবরকম উপায়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি বাইরের জগতের সঙ্গে। কিন্তু সাহায্য পাইনি। আরও কিছুদিন পরে দায়েশরা আমাদের গ্রামের হাই স্কুলে আটকে রাখে। এবার শর্ত: হয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো, বা মৃত্যুকে বেছে নাও। তারপরই ওরা নারী-পুরুষদের আলাদা করে দিল। প্রায় ৭০০ পুরুষকে গ্রামের প্রান্তে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারল। বাজেয়াপ্ত করল গয়নাগাটি, সম্পদ।

সারা: তোমার মাকেও কি ওরা খুন করেছিল?

নাদিয়া: চার বছর বা তার চেয়ে ছোট বাচ্চা ছেলেদের ওরা রেখে দিল। আর, মেয়েদের নিয়েছিল- যারা নয় বছরের বেশি। এমনকী, আশি বছরের বৃদ্ধাদেরও ছাড়েনি। তাদের মধ্যে আমার মা-ও ছিল। কেউ বলে, ওদের মেরে ফেলেছিল। কেউ বলে, মারেনি। অন্য কোথাও পাচার করে দিয়েছিল। সত্যি খবরটা কেউই জানি না। কিন্তু এই দু’মাস আগে, শিঞ্জরের কিছুটা এলাকা যখন উদ্ধার করা গেল উগ্রপন্থীদের হাত থেকে, মাটির তলায় কয়েকশো দেহ খুঁজে পাওয়া গেল। আমার পরিবারের ১৮ জন হয় মৃত কিংবা নিখোঁজ। অবশ্য দায়েশের আক্রমণে যতজন প্রাণ হারায়, প্রত্যেকেই তো আমারই পরিবার।

সারা: তোমাদের কয়েদ করে যে ওরা নিয়ে গেল, কী করল তারপর?

নাদিয়া: আমাদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে বাসে করে মসুলে নিয়ে গেল জঙ্গিরা। আমার দলে ছিল ১৫০ জন, সেখানে আমার তিন ভাইঝিও ছিল। যাওয়ার পুরো সময়টা জুড়ে ওরা আমাদের বুকে হাত দিচ্ছিল, দাড়ি ঘষছিল আমাদের গালে। আমরা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কী করতে চলেছে তারা আসলে! কিন্তু এটুকু বোঝা যাচ্ছিল যে, ভাল কিছু মোটেও হবে না আমাদের সঙ্গে। যারা মানুষ খুন করে, বয়স্কদেরও রেয়াত করে না, তাদের কাছে ভাল কিছুর প্রত্যাশা অন্ধের স্বপ্ন দেখার সমান।

মসুলে পৌঁছে ওদের হেড কোয়ার্টারসে তোলা হয় আমাদের। বিশাল জায়গা। কমবয়সি মেয়ে আর শিশুতে ভর্তি। প্রত্যেকেই ইয়াজিদি। একজন বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, আগের দিনই তিনি একটি গ্রুপের সঙ্গে এখানে পৌঁছেছেন। ৪০০ জনের গ্রুপ। প্রত্যেক ঘণ্টায় দায়েশের লোক আসছে আর নির্মমের মতো এক-একটা মেয়েকে বেছে নিয়ে যাচ্ছে। পরের পর ধর্ষণ। কোনও কোনও মেয়েকে বিক্রিও করা হয়েছে।

সারা: কী হল তারপর?

নাদিয়া: পরের দিন দায়েশের কিছুজন জোট বেঁধে এল। এবার এক একজনের জন্য একাধিক মেয়েকে তুলে নিয়ে গেল। কারও বয়স আমার চেয়ে অনেকখানি কম, ১০-১২ বছর বা তার চেয়েও ছোট। আমরা যারা একটু বড়, তাদের পিছনে লুকনোর চেষ্টা করছিল বাচ্চা মেয়েরা।

এর মধ্যে একটা মোটা মতো লোক আমাকে এসে চেপে ধরল। হিঁচড়ে নিয়ে গেল সিঁড়ির তলায়। সেই সময় আমার পাশ দিয়ে আরেকজন উগ্রপন্থী যাচ্ছিল, আমি তাকে চেপে ধরে অনুরোধ করলাম, এই মোটা মানুষটা আমাকে অন্তত না নিক! বদলে সে নিয়ে যাক আমাকে।

সারা: তোমার কী মনে হয়েছিল, তুমি এরকম মানুষকে সামলাতে পারবে না? তাই তার চেয়ে ক্ষুদ্রকায় কাউকে তুমি বেছে নিলে? কী হল তারপর?

নাদিয়া: আমি এটুকু স্পষ্ট বুঝতে তো পেরেই গিয়েছিলাম, যে-ই আমাকে নিয়ে যাক না কেন, ধর্ষণই করবে।… প্রত্যেকেই তো নৃশংস পিশাচ। এক সপ্তাহের বেশি আমাদের রাখত না ওরা। কখনও বা একদিন বা কয়েক ঘণ্টা পরেই আমাদের বিক্রি করে দেওয়া হত। এতটা ভয়ংকর ভাবতে পারিনি। এক-একজন বাচ্চা মেয়ে ওখানে থাকাকালীনই সন্তানসম্ভবা হয়ে গিয়েছিল। কী আর বলব!

সারা: যারা তোমাকে এভাবে আঘাত করল, অত্যাচার করল, কখনও জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেয়েছিলে কেন এরকম করছে তারা?

নাদিয়া: আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম একজনকে, কেন এরকম করছে তারা। কেন খুন করে দিল গ্রামের পুরুষদের? কেন ধর্ষণ করছে আমাদের? ওরা একটা কথাই বলছিল বারবার– ইয়াজিদিরা ‘কাফের’। আমরা যুদ্ধের উচ্ছিষ্ট। এর চেয়ে ভাল আচরণ আমাদের মানায় না। ইয়াজিদিদের সমূলে উপড়ে দেওয়াই তাদের কাজ। সেই কর্তব্যই তারা পালন করে চলেছে।

সারা: কীভাবে পালালে তুমি?

নাদিয়া: যে মানুষটার কাছে আমি প্রথমবার ধর্ষিত হয়েছিলাম, সেই সময়ই আমি প্রথম পালানোর চেষ্টা করেছিলাম। যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমি পারব না। তারপরেও আমি পালানোর জন্য মরিয়া ছিলাম। মসুলের সমস্ত জায়গায় দায়েশের লোক তখন ছড়িয়ে। সেবার জানলা দিয়ে আমি পালানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ধরা পড়ে গেলাম। তারপর আমাকে গণধর্ষণ করা হল। তাদের মতে, কোনও মহিলা যদি পালানোর চেষ্টা করে, তার এটাই যোগ্য শাস্তি। তারপর থেকে, আমি পালানোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। মসুলে যে লোকটার সঙ্গে আমি শেষবার ছিলাম, সে একাই থাকত। কিছুদিন ভোগের পর, আমাকে বিক্রি করে দেবে স্থির করায়, আমার জন্য কিছু জামাকাপড় এনে দিয়েছিল। আমি আবার সাহস এককাট্টা করে পালালাম। মসুলের একটি মুসলিম পরিবারের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইতে তারা আমাকে আশ্রয় দিল। তারা জানাল দায়েশের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। ইসলামিক আইডি বানিয়ে দিয়ে বর্ডারে পৌঁছে দিল ওই পরিবার।

সারা: আত্মহত্যা করার কথা কখনও ভেবেছিলে?

নাদিয়া: না, কখনও ভাবিনি। কারণ আমরা তো বারবার মরেছি। ভিতরে ভিতরে, ঘণ্টায় ঘণ্টায়।… আমার সঙ্গে যা হয়েছে, তা মানুষ করেছে, ঈশ্বর নয়। যদিও আমাদের গ্রামের অনেক মেয়েই আত্মহত্যা করেছিল।

সারা: তোমার ধর্ষকদের কী পরিণতি দেখতে চাও তুমি?

নাদিয়া: আমি তাদের আদালতে দেখতে চাই। বিচার চাই আমার ও সকল ইয়াজিদি মহিলার হয়ে।

সারা: তোমার কি মনে হয় তোমার এই বার্তা দায়েশের কাছে পৌছাচ্ছে?

নাদিয়া: আশা করছি।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement