বিশ্বদীপ দে: আটের দশকে যাদের ছোটবেলা কেটেছে, তারা সবাই কিম জং উনকে (Kim Jong Un) আগে থেকেই চিনত। আসলে ইন্দ্রজাল কমিকসের পাতায় জেনারেল তারাকিমো নামে এক স্থূলকায় অত্যাচারী একনায়কের কথা ছিল। যে শাসক বেতালের বউ ডায়নাকে ধরে নিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কার্যত তার দেশ যেন একটা অতিকায় বেলজার দিয়ে চাপা ছিল। বাইরে থেকে তার কোনও খবরই মিলত না। কেবল রকমারি গুঞ্জন ভেসে বেড়াত আকাশে বাতাসে। কিংবা ‘মিঃ ইন্ডিয়া’ ছবির মোগাম্বো। যে মানুষের মৃত্যু আর দুর্দশা দেখে ‘খুশ’ হত, সেও চেয়েছিল এক এমন সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হতে যেখানেই সেই শেষ কথা। এই সব দুর্ধর্ষ ভিলেনই যেন নতুন করে জন্ম নিয়েছে উত্তর কোরিয়ার (North Korea) শাসকের বেশে। তিনি এমন এক স্বৈরশাসক, যাঁকে ঘিরে প্রতিনিয়তই পাক খায় রহস্যের কুয়াশা। আর ভেসে আসে গা শিরশির করা সব কীর্তিকাহিনির কথা।
ঠোঁটের ডগায় সারাক্ষণ হাসির ছোঁয়া। বেশ আমুদে ধরনের চেহারা। হিন্দি ছবিতে একসময় যে ক্রুর ভিলেনদের দেখা মিলত তাদের সঙ্গে কোনও মিলই নেই কিমের। বরং হাসতে হাসতে যে কোনও নিষ্ঠুরতার দিকে পা বাড়ানোর মিথ তাঁর রহস্যময় ব্যক্তিত্বকে আরও গা ছমছমে করে তুলেছে। কিন্তু সত্যিই কি মানুষটা এমনই ভয়ংকর? শাসক হিসেবে যতই দোর্দণ্ডপ্রতাপ হোন না কেন, তাঁকে ঘিরে থাকা গল্পগুলির আসল চেহারা কি এমনই?
কীরকম গল্প? একটা-দু’টো উদাহরণ দেওয়া যাক। নিজের কাকা জ্যাং সং থিককে নাকি ঠান্ডা মাথায় খুন করিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করার পর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কীরকম সেই মৃত্যুদণ্ড? নগ্ন অবস্থায় তাঁর শরীরে ১২০টি ক্ষুধার্থ কুকুর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে তারা ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছিল প্রবীণ সেই ব্যক্তির শরীর! দ্বিতীয় উদাহরণ। উত্তর কোরিয়ার এক সেনা সমাবেশে থাকা অবস্থায় আলতো করে চোখ লেগে গিয়েছিল তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর। সেই ‘অপরাধে’ তাঁকে শয়ে শয়ে দর্শকের সামনে কামানের মুখে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হয়! উদাহরণ আরও আছে। পিরানহা ভরা পুকুরের মধ্যে ফেলে দিয়ে তিলে তিলে মৃত্যু মেরে ফেলা হয়েছিল উত্তর কোরিয়ার এক সেনা কর্তাকে। অভিযোগ, তিনি কিমের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র করেছিলেন।
এই সব মিথ যত ছড়িয়েছে, তত যেন হিটলার-মুসোলিনিদের নিকটাত্মীয় হয়ে উঠেছেন কিম। কিন্তু ঘটনা হল, উত্তর কোরিয়া এমনই গোপনীয়তায় ভরা দেশ, যার গভীরে থাকা যে কোনও খবরই অতিরঞ্জিত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থেকে যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ঢুলে পড়ার কারণে মৃত্যুদণ্ডের ঘটনাটির কথা। ওই সেনাকর্তাকে পরে আর কখনও দেখা যায়নি। ফলে তাঁর মৃত্যুর দাবিটা মিথ্যে না হলেও অন্য সূত্রের দাবি, দেশের তথ্য পাচারের প্রমাণ মিলেছিল প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে। নিছকই ঢুলে পড়াকে কাঠগড়ায় তুলে ‘লঘু পাপে গুরুদণ্ড’ দেওয়া হয়নি তাঁকে। আসলে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও রয়েছে, ‘শত্রু’ কিমকে বেকায়দায় ফেলতেই এভাবে অনেক সময় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বাড়ানো হয়েছে নানা ঘটনা। আরও নিপুণ রঙে রাঙিয়ে তোলা হয়েছে ‘অত্যাচারী’ কিমের ভাবমূর্তিকে।
আসলে মসনদে বসার পর থেকেই কিম এমন সব কাণ্ড ঘটিয়েছেন, যে তাঁকে ঘিরে এই সব মিথকে দারুণ ভাবে ফিট করিয়ে দেওয়ার সুযোগও মিলেছে। ২০১১ সালে বাবা এবং উত্তর কোরিয়ার প্রাক্তন স্বৈরশাসক কিম জং ইলের মৃত্যুর পরে দেশের শাসনভার হাতে নেন তিনি। মনে করা হচ্ছিল, তরুণ বয়সে দেশের শীর্ষ পদে বসে নিশ্চয়ই বাবার আমলের মন্ত্রী-সেনা কর্তাদের পরামর্শে দেশ চালাবেন তিনি। কিন্তু তিন মন্ত্রী এবং ৭ জন জেনারেলকে পদ থেকে বহিষ্কার করেন কিম। কয়েকজনকে হত্যাও করা হয়। ফলে কোরিয়ান এজেন্সিগুলি তাঁকে যতই ‘মহান’ হিসেবে দেখাতে শুরু করুক না কেন, শুরু থেকেই একনায়ক হয়ে ওঠার সব মশলাই যে মজুত ছিল কিমের মধ্যে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতেই রাষ্ট্রসঙ্ঘের হাই কমিশনার দাবি করেন, কিম ক্ষমতায় আসার পর থেকেই উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘন আরও বেড়ে গিয়েছে। পরের বছরই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে কিমকে তোলার দাবি উঠে যায়।
সময় গড়িয়েছে। মাত্র দশ বছরেই তৈরি হয়েছে আজকের কিম জং উনের সুবিশাল ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ইমেজ। থেকে থেকেই তিনি হুমকি দেন পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের। বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরেই একটি সাবমেরিন লঞ্চড ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রদর্শিত করে দাবি করেন, এটাই নাকি ‘বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী’ অস্ত্র। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। আমেরিকা-সহ গোটা বিশ্বকে বুঝিয়ে দেওয়া, কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে উত্তর কোরিয়া।
এদিকে গত এক বছরে উত্তর কোরিয়ার মানুষের অবস্থা আরও বিপন্ন হয়েছে। বরাবরই সেই দেশের সাধারণ মানুষের দুর্দশার কথা সামনে এসেছে। কিন্তু অতিমারীর সময়ে তা যেন সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রায় গোড়া থেকেই গোটা দেশটাকে ওই শুরুতে যেমন বললাম তেমন করে বেলজারচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। দেশের সীমান্তে জারি করা হয় ‘শুট অ্যাট সাইট’ নির্দেশ। কেউ যাতে পালিয়ে ‘বন্ধু’ দেশ চিনে (China) গিয়ে আশ্রয় না নিতে পারে তার ব্যবস্থা পাকা। ঘোষণা করা হয়েছে, সেদেশে নাকি পা ফেলতে পারেনি খোদ করোনাও! আর এই সব দর্পের আড়ালেই নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। বছরের মাঝখানে হওয়া বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে আরও করুণ হয়েছে পরিস্থিতি। খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে। আমদানিও বন্ধ। ওষুধ, খাদ্যের অভাবে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। দেশজুড়ে কেবলই দুর্ভোগ আর অস্থিরতা। অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষ তীব্র খাদ্যাভাবে ভুগছে। তবু কিমের ভয়ে সকলেই চুপ! এই ভয়াবহ গোপনীয়তার মধ্যেই নানা ধরনের টুকরো খবর বাইরে আসছে। তা জুড়ে জুড়ে এমন ছবিই ফুটে উঠছে। পরিস্থিতি দেখে বহু দেশই চেয়েছে উত্তর কোরিয়ার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু কিম নির্বিকার।
সত্যিই কি নির্বিকার? গত অক্টোবরে দেশটির ক্ষমতাসীন ওয়ার্কার্স পার্টির ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাহলে কেন কেঁদে ফেললেন কিম? স্বীকারও করে নিলেন দেশের মানুষকে এই বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে পুরোপুরি সফল হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। কিন্তু এরপরও নিজের জেদ বজায় রেখে দিয়েছেন ডাকসাইটে ‘জেনারেল’। যা দেখে সন্দেহ জাগে, ওই কান্নাও পূর্বপরিকল্পিত এবং নিজের ইমেজের এক অন্য দিক ফুটিয়ে তোলার কৌশল নয় তো? কে জানে!
শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার থেকে কিমকে বিরত রাখা যেমন দরকার, তেমনই খেয়াল রাখতে হবে সেদেশের সাধারণ মানুষের কথাও। মানবাধিকারের করুণ হাল থেকে কবে মুক্তি পাবেন তাঁরা? রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্য দেশগুলির তা নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই। যদিও কিমকে কে বোঝাবে? ক্ষমতার বলয়ের আড়ালে রক্তমাংসের কিম কি কখনও ভাববেন না তাঁর দেশের অভুক্ত, দরিদ্র মানুষদের কথা? হাল্লার রাজার মতো একদিন তাঁরও সম্বিৎ ফিরবে কি? বাস্তবের পৃথিবী কি কখনও সখনও এমন রূপকথা তৈরি করে ফেলতে পারে না?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.