কৃশানু মজুমদার ও মণিশংকর চৌধুরী : ”ছিলাম ফুটবলার। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অনুভব করলাম, আমি পুরোদস্তুর রাজনীতির লোক হয়ে গিয়েছি।”
ইরানের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সামগ্রিক ছবি সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের কাছে তুলে ধরার সময়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছিলেন মেহমুদ খাবাজি। খেলতে এসেছিলেন কলকাতায়। এই শহর ছাড়ার পরে ইরানে আর ফেরেননি তিনি। অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে ফেলেন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখেশুনে ব্যথিত মজিদ বিসকরের বন্ধু।
আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্র–মজিদ বিসকর, জামশিদ নাসিরি ও মেহেমুদ খাবাজিকে সই করিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। ১২ নম্বর জার্সি পরে মাঠে ফুল ফোটাতেন মজিদ। জামশিদ পরতেন ৯ নম্বর জার্সি। আর খাবাজি প্রথমটায় বুঝেই উঠতে পারেননি কত নম্বর জার্সি তিনি পরবেন।
কলকাতায় এসে স্মৃতিচারণ করে বন্ধু মজিদ বলেছিলেন, ”১২ আর ৯ যোগ করলে ২১ হয়। খাবাজির পিঠে উঠল ২১ নম্বর।’’ তার পরের ঘটনা ইতিহাস। তিন বন্ধু জিতে নিয়েছিলেন কলকাতার ফুটবলপাগলদের মন। বুট জোড়া তাঁরা তুলে রেখেছেন বহুদিন হল। কলকাতা এখনও ভোলেনি এই ইরানি ত্রয়ীর রূপকথা।
সময় এখন বদলে গিয়েছে। গঙ্গা দিয়েও গড়িয়ে গিয়েছে অনেক জল। জামশিদ এখন কলকাতায়। ইরানের খোরামশায়ারে রয়েছেন মজিদ। আর খাবাজি এখন সুইডেনে। সেখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন তিনি। বৃহস্পতিবার দুপুরে হোয়াটসঅ্যাপে খাবাজি লিখলেন, ”ইরান আজ পথে নেমেছে। স্বাধীনতার দাবিতে সরব মহিলারা।”
মাহসা আমিনির খুনের পর থেকেই আগুন জ্বলছে ইরানে। ‘নীতি পুলিশে’র বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন তরুণীরা। হিজাব পুড়িয়ে, চুল কেটে ইসলামের নামে মহিলাদের শিকলবন্দি করার প্রতিবাদ করছেন তাঁরা। প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন পুরুষরাও। এমন পরিস্থিতিতে ইরান সরকারের আজব দাবি, ‘’পুলিশের মারে নয়, রোগে মৃত্যু হয়েছে মাহসার।”
ইরানের বর্তমান পরিস্থিতির প্রসঙ্গ উত্থাপ্পন করতেই বিস্ফোরণ ঘটালেন কলকাতায় খেলে যাওয়া খাবাজি। গর্জে উঠে তিনি বলছেন, ”আমি ফুটবলার ছিলাম। আমার ধ্যান জ্ঞান খেলা। ইরান এখন বিপন্ন। আলি দাই, আলি করিমিরা আজ ঘোর সমস্যায়। দেশের খেলাধুলো প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। এই অশিক্ষিত প্রশাসন যুব সম্প্রদায়ের মন বোঝে না। সেই ক্ষমতাই নেই ওদের। এই সরকার মনে করে কেবল ছ’ বছরের স্কুল শিক্ষাই যথেষ্ট। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ এরা অনুধাবন করতে পারে না। ছাত্ররা আজ নিপীড়িত ইরানে। অধ্যাপকদের স্থান কারাগারে। শিক্ষার বড় অভাব আমার দেশে। কোন পথে যাচ্ছে আমার দেশ?” দেশের মানুষের হয়ে প্রশ্ন তুলছেন খাবাজি।
খাবাজি-মজিদের ইরান এখন ধুঁকছে। ১ মার্কিন ডলার এখন ৪২ হাজার রিয়াল। খাবাজি বলছেন, ”দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। জাতীয় সম্পদ লুটে নিচ্ছে সরকার। আর এর ফলাফল ভুগতে হচ্ছে আমজনতাকে।”
হিজাব (Hijab) বিদ্রোহের পর নিজের অবস্থান থেকে একটুও নড়তে নারাজ প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সরকার। এহেন পরিস্থিতিতে তেহরানের উপর চাপ বৃদ্ধি করে ইরানের ‘নীতি পুলিশে’র উপর নিষেধাজ্ঞা চাপায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এই প্রেক্ষিতে মজিদ-জামশিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খেলে যাওয়া খাবাজি বলছেন, ”খামেনেই সরকার যেভাবে বিক্ষোভকারীদের উপরে দমনপীড়ন চালাচ্ছে, তার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশের উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে। সুইডেন, স্টকহোম-সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হিজাবের পক্ষে প্রতিবাদে নেমে সমস্যা তৈরি করছে ইরানেরই কিছু মানুষ। তাঁদের প্ররোচনা দিচ্ছে তেহরান সরকার। সোজা কথায় এই সরকারের জন্যই বহির্বিশ্বে বদনাম হচ্ছে দেশের।”
ইরানের (Iran) পর খাবাজির দ্বিতীয় ঘর কলকাতা। এই শহর ছাড়ার পরে আর নিজের দেশেই ফেরেননি। এদিন তিনি বলছিলেন, ”ইরান ছেড়েছি ৪৫ বছর হয়ে গেল।” কলকাতার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে খাবাজি বলছেন, ”কলকাতায় খেলার সময়ে ইরানের দূতাবাস থেকে আমাদের উপরে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতোল্লা রুহুল্লা খোমেইনির পোস্টার হাতে নিয়ে আমরা যেন স্লোগান দিই, খোমেইনি জিন্দাবাদ, লং লিভ ইসলামিক রেভোলিউশন। মজিদ, আমি আর জামশিদ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করি সেই নির্দেশ। জানিয়ে দিই, আমরা খেলতে এসেছি ভারতে, কোনও রকম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আমরা জড়াতে চাই না।”
খানিকটা অভিযোগের সুরে তিনি বললেন, “কলকাতার পুলিশ সব জানত। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের উপর ইরানি দূতাবাসের প্রভাব ছিল। আমরা চাপে ছিলাম। আমি আজ পর্যন্ত ইরানের দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট নবীকরণ করাইনি। কলকাতা থেকে ফিরে সুইডেনের নাগরিকত্ব নিয়ে ফেলেছিলাম। আজও দেশে ফিরিনি। যেদিন এই সরকার ক্ষমতাচ্যুত হবে সেদিন আমি দেশে যাব।”
ভারতে থাকার স্মৃতি এখনও টাটকা তাঁর মনে। কাশ্মীরে খেলতে গিয়েছিলেন। ভূস্বর্গের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে খাবাজি বলছেন, ”কাশ্মীরে গিয়ে তো আমরা তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ওখানকার ছোট ছোট দোকানগুলোতে যে পাত্র তৈরি করা হচ্ছে, তার গায়ে খোমেইনির ছবি আঁকা হচ্ছে। আমরা প্রতিবাদ করি। শিল্পীদের বলি, এঁর ছবি আঁকছ কেন তোমরা? এ মোটেও ভাল লোক নয়। ওদের উত্তর শুনে আমরা বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। শিল্পীরা বলেছিল, ইরানের দূতাবাস থেকে খোমেইনির ছবি আঁকা পাত্র তৈরির কথা বলা হয়েছিল। তার বিনিময়ে ওই শিল্পীদের টাকা দেওয়া হত।”
খাবাজি আরও বলেন, ”আপনাদের দেশের সরকার ও গোয়েন্দা বিভাগ তেহরানের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিল। তাই বহু সন্দেহভাজন ইরানি নাগরিককে কাশ্মীরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ভারতের ভিসাও দেওয়া হয়নি সেই সময়ে।”
ইরানের প্রয়াত সুপ্রিম লিডার আয়াতোল্লা খোমেইনিকে একহাত নিয়ে খাবাজি বলছেন, ”ইরানের সম্রাটকে সরিয়ে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতা দখল করে বসেন খোমেইনি। এক বছরের মধ্যেই ১২ হাজার লোককে খুন করা হয় তাঁর নির্দেশে। ভয়াবহ গণহত্যা হয় দেশে। আজও একই ভাবে দেশে মানুষ খুন হচ্ছেন। হিজাব বিদ্রোহে এখনও পর্যন্ত প্রায় আটশো জনকে খুন করেছে সরকারি বাহিনী। তবে এখন লড়াই হচ্ছে এই বর্বর সরকারের বিরুদ্ধে। রুখে দাঁড়িয়েছে কমিউনিস্ট দলগুলো, সশস্ত্র সংগ্রাম করছে কুর্দ বিদ্রোহী ও মুজাহিদিনরা। জানি না কবে শেষ হবে এই যুদ্ধ।”
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তেহরানের দাবি, এই বিক্ষোভের পিছনে হাত রয়েছে আমেরিকার। একইসঙ্গে সরকারের আরও দাবি, এই আন্দোলনকে মদত দিচ্ছে ‘কোমলা’ বলে ইরানের একটি বামপন্থী সংগঠন এবং বেশ কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠী। ইতিমধ্যেই ইরানের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমের প্রদেশ থেকে একাধিক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কোর।
প্রতিবাদীদের উদ্দেশে বার্তা দিয়ে খাবাজি বলছেন, ”তোমাদের পাশে রয়েছি আমি। তোমাদের লড়াইকে কুর্নিশ জানাই। থেমে থেকো না। এগিয়ে যাও। একদিন জয় হবে।”
ইরানের মানুষ নারীমুক্তি ও স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর। সেরকমই এক ভোরের অপেক্ষায় খাবাজিও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.