সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ ও ছয় বাণিজ্যের অংশীদার দেশের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি বা রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপে (আরসেপ) যোগ দেবে না ভারত। সরকারের একটি শীর্ষ সূত্র স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে, বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য চুক্তি ‘আরসেপ’ নিয়ে ভারতের সংশয়ের নিরসন হয়নি। তাই উদ্বেগ নিয়ে চুক্তিতে শামিল হচ্ছে না তারা। সরকারি সূত্রের দাবি, মূল বিষয়গুলি নিয়ে আপস করা হবে না। এই চুক্তির প্রবল বিরোধী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং কংগ্রেস-সহ কয়েকটি বিরোধী দল। কেন্দ্রের মনোভাব সামনে আসার পরেই কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরজেওয়ালা দাবি করেন, তাঁদের জোরাল প্রতিবাদের ফলেই কেন্দ্র এ বিষয়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।
এশিয়ার ১৫টি দেশ এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির অংশীদার হবে। কিন্তু চিনের মদতপুষ্ট এই চুক্তি নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নয় ভারত। এই আবহেই ব্যাংককে অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস-এর (আসিয়ান) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সোমবার ‘আরসেপ’ সংক্রান্ত খসড়া চুক্তি ঘোষণার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভারতের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গভীর রাত পর্যন্ত আলোচনা চলে। ভারত চেয়েছিল ‘পারষ্পরিক সুবিধাযুক্ত চুক্তি’, যাতে সব পক্ষই উপকৃত হয়। অবাধ এবং মুক্ত বাজার ও শুল্ক নিয়ে ভারতের যে উদ্বেগ, তা নিয়ে কোনও সন্তোষজনক কোনও উত্তর মেলেনি। ভারতের আশঙ্কা, চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সস্তার চিনা কৃষিজ ও শিল্প সামগ্রীতে ভরে যাবে দেশের বাজার। আসিয়ান সম্মেলনের ফাঁকে বৈঠক করেন চুক্তির অন্তর্ভুক্ত ১৬টি দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীরা। কিন্তু ব্যাকচ্যানেলে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মেটেনি। ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে যে, আমেরিকা ও চিনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের মধ্যেই ভারতকে বাদ দিয়ে একটি অস্থায়ী চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে বাকি ১৫টি দেশ।
সরকারি সূত্রে দাবি, বাস্তব পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে দেশের গরিব ও পরিষেবা ক্ষেত্রের স্বার্থ রক্ষার কথা ভাবা হয়েছে। তারই প্রতিফলন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যে। তিনি জানিয়েছেন, খসড়া চুক্তিতে ভারতের উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরা হয়নি। ভারত চাইছে পণ্য, পরিষেবা ও বিনিয়োগের মতো প্রতি স্তম্ভেই যেন ভারসাম্য থাকে। দেশের কৃষক, ব্যবসায়ী, পেশাদার এবং শিল্প, কর্মী ও ক্রেতাদের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এদের জন্যই ভারতের বাজার এতটা বিশাল। তঁাদের তরফে যখন আমি এই চুক্তির মূল্যায়ন করি, আমি কোনও ইতিবাচক উত্তর পাইনি। ফলে, না গান্ধিজির আদর্শ না আমার নিজের বিবেক, কেউই চুক্তির পক্ষে মত দেয়নি।” আমদানি বৃদ্ধি, বাণিজ্য ঘাটতি, দেশীয় শিল্পকে বাঁচানোর মতো বিষয়গুলি নিয়ে আগেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল ভারত। সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের মর্যাদা না পাওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরে নয়াদিল্লি।
বিষয়টি সামনে আসার পর প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরজেওয়ালা টুইট করেন, ‘কৃষক, দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রেতা, মৎস্যজীবী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ থেকে সরে এসেছে বিজেপি সরকার। কংগ্রেস এবং রাহুল গান্ধীর তীব্র প্রতিবাদের জেরে। জাতীয় স্বার্থের জন্য লড়াই করা প্রতে্যক মানুষের জয় হল। বিজেপি সরকারের ভ্রান্ত অর্থনীতির জেরে ব্যাপক বেকারত্ব, আর্থিক ও কৃষি সংকট তৈরি হয়েছে। ‘আরসেপ’ চুক্তি সই করলে সংকট আরও ঘনীভূত হত।’
আমেরিকার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা চিনকে কোণঠাসা করতে যে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপের (টিপিপি) পরিকল্পনা করেছিলেন, তাতে বাদ সেধেছিলেন তাঁর উত্তরসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্প। সঙ্গে সঙ্গেই সুযোগ লুফে নেয় চিন। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ টিপিপি-র বিকল্প একটি বাণিজ্যিক মঞ্চ তৈরি করার ভাবনাচিন্তা প্রকাশ করতেই চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাদের এ ব্যাপারে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। তারই ফলশ্রুতি রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ বা আঞ্চলিক পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব সংক্ষেপে আরসেপ।
আসিয়ান-ভুক্ত দশটি দেশ ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও এই ব্লকের ছ’টি বাণিজ্যের অংশীদার দেশ-সব মিলিয়ে ১৬টি দেশের মধ্যে সাত বছর ধরে আলোচনা চলছে। কিন্তু ঐকমত্য হয়নি। আসিয়ান ব্লকের ছ’টি অংশীদার দেশ হল ভারত, চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। ‘আরসেপ’ ব্লকটি বিশ্বব্যাপী মোট দেশজ উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ এবং বিশ্বের প্রায় জনসংখ্যার অর্ধেক অংশ। চুক্তির লক্ষ্য আসিয়ান দেশ ও তাদের অংশীদারদের মধ্যে আধুনিক, উচ্চমানের এবং পারস্পরিক লাভজনক একটি বাণিজ্য চুক্তি তৈরি করা।
এদিকে নানা বিষয়ে প্রশ্ন তোলায় কয়েকটি দেশ নয়াদিল্লিকে বাদ দিয়েই চলার কথা ভাবছে। চিনের হয়ে মুখ খুলেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মহাথির বিন মহম্মদ। তাঁর দাবি, এশিয়ার দেশগুলিকে আমেরিকার আগ্রাসনে বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, তার জন্য যদি চিনের অর্থনীতির কাছাকাছি আসতে হয়, তা হলেও। কিন্তু তাতে বাদ সাধে অন্য দেশগুলি। কারণ, ওজনদার ভারত চুক্তির অংশ হলে চিন একাধিপত্য করতে পারবে না বলেও মনে করছে তারা। এবারের সম্মেলনে আমেরিকা খুবই গুরুত্বহীন পর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে। যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের মোকাবিলায় ওয়াশিংটনের আন্তরিকতা নিয়ে সংশয় জাগাচ্ছে। তাই ভারতকে চটিয়ে চিনের ‘দাদাগিরি’র শিকার হতে চাইছে না এই অঞ্চলের কোনও দেশই। জাপানের একটি নিউজ চ্যানেল জানিয়েছে, চিনের সস্তার পণ্য যাতে যাতে ভারতের বাজারে আরও বেশি করে ঢুকে না পড়ে সে জন্য বেশ কয়েকটি পণ্যের উপর থেকে আমদানি শুল্ক বাতিল করতে নয়াদিল্লি রাজি নয়।
যদিও এখন যা পরিস্থিতি, তাতে এই চুক্তি সই হওয়া কার্যত অসম্ভব। ভারতকে এই চুক্তিতে শামিল করার পক্ষে রয়েছে বেশিরভাগ দেশই। সূত্রের খবর, আরও কয়েক মাস এ নিয়ে আলোচনা চলবে এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলির মধ্যে বহু প্রতীক্ষিত এই চুক্তি সই হতে পারে আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসে।
[আরও পড়ুন: বিমানে আগুন, বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.