সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহর আলেপ্পো৷ আজ পুরোটাই কার্যত ধ্বংসস্তূপ৷ কালের নিয়মে নয়, ক্ষমতার লড়াইয়ের সৌজন্যে৷ প্রায় দেড় দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরটি৷ একদিকে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অনুগত বাহিনী৷ অন্যদিকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী৷ দুই পক্ষের সংঘর্ষে ঝড়ছে রক্ত৷ এই প্রেক্ষাপটে জানা গিয়েছে, হঠাৎ হামলা চালিয়ে আলেপ্পোর একটি বড় এলাকা দখল করে নিয়েছে বিদ্রোহীরা। আর এই পরিস্থিতি মনে করাচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশকে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। আলেপ্পো শহরের অর্ধেকই এখন নাকি তাদের নিয়ন্ত্রণে। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের পরিচালক রামি আবদুল রহমানের কথায়, লড়াই ছাড়াই অনেক জায়গায় সরকারি বাহিনী পিছু হটেছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, এই তাহরির আল-শাম আল কায়দার শাখা সংগঠন হিসেবেই পরিচিত। অর্থাৎ, গণতন্ত্র ফেরানোর লড়াই এখন কার্যত জেহাদিরা হাইজ্যাক করে নিয়েছে। জানা গিয়েছে, গত বুধবার থেকে আলেপ্পোয় সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে বিদ্রোহীরা। ময়দানে সাফল্য আসতেই শুক্রবার এক ভিডিও বার্তা দিয়েছে আল-শামের প্রধান আবু মহম্মদ আল জোলানি। তাঁর কথায়, “আমরা দ্রুত আলেপ্পো দখল করব।” পালটা বিবৃতিতে সিরিয়ার সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সন্ত্রাসবাদীদের হামলা রুখে দেওয়া হয়েছে।
শেষ পাওয়া তথ্য মোতাবেক, এই লড়াইয়ে এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৪৪ জন বিদ্রোহী যোদ্ধার। নিহত আসাদ বাহিনীর ৮৭ জওয়ান। গতকাল পর্যন্ত দু’পক্ষের সংঘাতের বলি ২৪জন সাধারণ মানুষ। শহরের একাধিক সেনাঘাঁটির দখল নিয়েছে আল-শাম বাহিনী। বিশ্লেষকদের মতে, এই হামলার আঁচ পায়নি আসাদের গোয়েন্দা বিভাগ। ফলে প্রস্তুত ছিল না সরকারি বাহিনী।
উল্লেখ্য, ২০০০ সাল থেকেই শক্ত হাতে সিরিয়া শাসন করছেন আসাদ। তবে জলঘোলা হতে শুরু করে ২০১১ সালে। আরব বসন্তের হাওয়ায় উত্তাল হয়ে ওঠে মরুপ্রদেশটি। আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে একনায়ক হঠাও, গণতন্ত্র ফেরাও স্লোগানে। শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ। আসাদকে গদিচ্যুত করতে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিদ্রোহীদের যৌথমঞ্চ ‘সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস’ (এসডিএফ)। কুর্দ বাহিনী পিপলস প্রোটেকশন ইউনিটের (ওয়াইপিজি) নেতৃত্বে আরম্ভ হয় এক অসম যুদ্ধ। শুরুর দিকে লড়াইয়ে আলেপ্পো হাতছাড়া হলেও, ২০১৬ সালে তা পুনরোদ্ধার করে আসাদ বাহিনী। পাশাপাশি, ইরান ও রাশিয়ার মদতে বিদ্রোহীদেরও কোণঠাসা করে দেওয়া হয়। তবে সময়ের সঙ্গে মার্কিন ও পশ্চিমের দেশগুলির মদতে সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে জবরদস্ত পালটা মার দিতে শুরু করে বিদ্রোহীরা। সবমিলিয়ে. রাশিয়া, আমেরিকা, ইরানের মতো শক্তিগুলোর আধিপত্য বিস্তারের খেলায় বোড়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে সিরিয়া।
এদিকে, আলেপ্পোর লড়াইয়ে আল-শামের ভূমিকায় উদ্বিগ্ন অনেকেই। সিঁদুরে মেঘ দেখছে এসডিএফ। মিলিশিয়াটির মুখপাত্র ফারহাদ শামির মতে, জঙ্গি সংগঠন আল-শামকে নিয়ন্ত্রণ করছে তুরস্ক। তাদের নিশানায় রয়েছে কুর্দরা। উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় কুর্দ নিয়ন্ত্রিত রোজাভা দিয়ে যুদ্ধের মাঝে ফেঁসে যাওয়া নিরীহ মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে এসডিএফ। তবে শামির আশঙ্কা, আসাদ বাহিনীকে ছেড়ে আল-শামের ফৌজ আলেপ্পো-সহ কুর্দ এলাকায় হামলা চালাতে পারে। আর এই পুরোটাই হচ্ছে তুরস্কের অঙ্গুলীহেলনে। তবে সমস্ত পরিস্থিতি মোকাবিলায় তৈরি এসডিএফ। বিশ্লেষকদের মতে, ইজরায়েলের মারে হেজবোল্লা দুর্বল হয়ে পড়তেই হামলা চালিয়েছে আল-শাম। তারা জানে, লেবাননের লড়াই ছেড়ে এই মুহূর্তে আসাদের পাশে দাঁড়ানো হেজবোল্লার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। প্রায় একদশক ধরে ইরানের নির্দেশে আসাদ সরকারের হয়ে লড়াই করছে হেজবোল্লা। পাশাপাশি মদত দিচ্ছে রাশিয়া। তবে ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কো এখন নিমজ্জিত। তাই সিরিয়া এখন পুতিনের কাছে গৌণ। এই সমীকরণেই হামলা চালাচ্ছে আল-শাম। তবে ইতিমধ্যেই আসাদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়েছে মস্কো ও তেহরান। সব মিলিয়ে সিরিয়ায় বিশ্ব কূটনীতি এবং সামরিক সংঘাতের এক অদ্ভুত সমীকরণ তৈরি হয়েছে।
আর এই পরিস্থিতি মনে করাচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশকে। সেদেশে গণতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা এখন জেহাদিদের নিয়ন্ত্রণে। দুর্বিষহ হয়ে উঠছে হিন্দুদের জীবন। তেমনই সিরিয়াতেও আরব বসন্ত ফেরানোর যে দাবি উঠেছিল, সেখানেও একই ছবি। আল-শাম যেভাবে আন্দোলন হাইজ্যাক করে নিয়েছে তা কোনও এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিচ্ছে সিরিয়া ও বাংলাদেশকে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.