সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের (Queen Elizabeth II) মৃত্যু এক দীর্ঘ যুগের অবসান। কথাটা বহু ব্যবহারে ক্লিশে মনে হতে পারে। কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই ব্রিটেনের সম্রাজ্ঞীর শাসনকাল বহু ইতিহাসের সাক্ষী। তবে সেসব নিয়ে বেশি আগ্রহ বিশেষজ্ঞদেরই। অতি রক্ষণশীল রাজপরিবারের প্রতি সাধারণ মানুষের কৌতূহল অন্য দিকে। কী হয় বাকিংহাম প্যালেসের ভিতরে? কেমন করে কথা বলেন রাজপরিবারের সদস্যরা, কী খান তাঁরা অথবা ঘরে কেমন পোশাক পরে থাকেন। এই সব প্রশ্ন তো রয়েছেই। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনা প্রাসাদের অন্দরমহলে জমে থাকা কেচ্ছা ও শাশুড়ি-বউমার কোন্দল নিয়ে। এলিজাবেথের মৃত্যুতে সেই বিষয়গুলি আবারও যে আলোচনায় উঠে আসবে তাতে আর আশ্চর্য কী?
ডায়না ও এলিজাবেথ
আর এই বিষয়ে নিঃসন্দেহে পয়লা নম্বরে ডায়না (Diana Princess of Wales) ও এলিজাবেথের সম্পর্ক। পুত্রবধূর সঙ্গে কেমন রসায়ন ছিল শাশুড়ির? ১৯৯৭ সালে যখন আকস্মিক দুর্ঘটনায় ডায়নার মৃত্যু হয়, সেই সময় স্কটল্যান্ডে ছুটি কাটাচ্ছিলেন এলিজাবেথ। দুঃসংবাদ পেয়েও প্রাথমিক ভাবে লন্ডনে ফিরতে আগ্রহী ছিলেন না তিনি। ততদিনে অবশ্য ডায়না প্রাক্তন। চার্লসের সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয় ১৯৯২ সালে। ডিভোর্স হয়ে যায় ১৯৯৬ সালে। তবুও মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণের সময় রানির এই কাঠিন্য রানির জনপ্রিয়তার গ্রাফ রাতারাতি অনেকটাই নামিয়ে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি মত বদলান। ডায়নাকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণও দেন। স্বীকার করে নেন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও হাসিখুশি থাকতে জানতেন তাঁর প্রাক্তন পুত্রবধূ।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক কেট উইলিয়ামস জানাচ্ছেন, দু’জনের সম্পর্ক মন্দ ছিল না। কিন্তু দূরত্ব ছিল। সমাজসেবায় বউমার মনোযোগকে তিনি সম্মান করতেন। আবার তাঁর খামখেয়ালি আচরণকে পছন্দও করতেন না। ডায়না কিন্তু শাশুড়িকে বরাবরই শ্রদ্ধা দেখিয়ে এসেছেন। প্রকাশ্যেই যে কোনও আহ্লাদী বউমার মতোই জানিয়েছিলেন, ”আমার শাশুড়িই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শাশুড়ি।” এমনিতেই ডায়না মোটেই রাজপরিবারে ‘বহিরাগত’ ছিলেন না। তাঁর ভাই চার্লস স্পেনসারের ‘গডমাদার’ অর্থাৎ ধর্মমা ছিলেন তিনি। তাই ডায়নাকে পুত্রবধূ হিসেবে মানতে আপত্তি ছিল না তাঁর। প্রথম দিকে সব ঠিকই ছিল। কিন্তু যত সময় এগিয়েছে, চার্লসের সঙ্গে ডায়নার দূরত্ব বেড়েছে, ততই যেন শীতল কাঠিন্যে ভরে গিয়েছে ডায়না-এলিজাবেথের সম্পর্ক। ডায়নার প্রাইভেট সেক্রেটারি প্যাট্রিক জেপসনের মতে, ডায়নার আশা ছিল তাঁদের দাম্পত্যের ভাঙন রুখতে এগিয়ে আসবেন এলিজাবেথ। কিন্তু তিনি তা করেননি। আসলে আপাত ভাবে অপছন্দ না করলেও দু’জনের কড়া ব্যক্তিত্বই কখনও তাঁদের কাছাকাছি আসতে দেয়নি।
মেগান ও এলিজাবেথ
ডায়না-এলিজাবেথ নিয়ে গুঞ্জন যাই থাক, প্রকাশ্যে কিছু আসেনি। কিন্তু নাতি হ্যারির স্ত্রী মেগান মর্কেল (Meghan Markle) রাজপরিবারের বিরুদ্ধে রীতিমতো ঝড় তুলে দিয়েছিলেন প্রকাশ্যে মুখ খুলে। গত বছরের মার্চে বিখ্যাত ফরাসি (France) ম্যাগাজিন ‘শার্লি এবদো’ (Charlie Hebdo) একটা কার্টুন ছেপেছিল। যা ছাপা হয়েছিল একেবারে প্রচ্ছদে। দেখা গিয়েছিল, মেগান মর্কেলের গলায় হাঁটু চেপে বসে রয়েছেন তাঁর দিদিশাশুড়ি রানি এলিজাবেথ। ঠিক যেভাবে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে মেরে ফেলেছিলেন মিনিয়াপোলিসের এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্মী। ওই কার্টুনের শিরোনাম ছিল ‘মেগান কেন বাকিংহাম প্যালেস ছেড়ে দিলেন?’ রানির হাঁটুর নিচ থেকে প্রিন্স হ্যারির স্ত্রী মেগানের জবাব, ‘কারণ আমি নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না।’ এই কার্টুন নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল প্রবল।
আসলে সেই সময়ই মার্কিন টক শো হোস্ট ওফ্রা উইনফ্রেকে বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন মেগান। সেখানে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড থেকে রাজপরিবার সবাইকেই একহাত নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর চাঞ্চল্যকর অভিযোগ ছিল, রাজপরিবার তাঁদের সন্তানের গায়ের রং নিয়ে চিন্তিত ছিল। এব্যাপারে হ্যারির সঙ্গেও আলোচনা করেছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। আসলে মেগানের বাবা শ্বেতাঙ্গ হলেও মা ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। সেই কারণেই রাজপরিবারের উদ্বেগ ছিল, মেগানের সন্তান হয়তো পুরোপুরি ফরসা নাও হতে পারে। অভিমান উগরে দিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল, তিনি আর বেঁচে থাকতেই চাইছিলেন না!
তবে শুরুতে সম্পর্কটা কিন্তু ভালই ছিল। ইতিহাসবিদ উইলিয়ামস জানাচ্ছেন, নাতি হ্যারির সঙ্গে এলিজাবেথের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মেগানকে নিয়েও তিনি খুশিই ছিলেন। কিন্তু ২০২০ সালে রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করেন হ্যারি-মেগান। যা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে ‘মেগজিট’ নাম পায়। এই সময় থেকেই বাকিংহাম প্যালেস ও এলিজাবেথের সঙ্গে মেগানের দূরত্ব একলাফে অনেকটাই বেড়ে যায়। যা চরম আকার নেয় বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারটির পরে। তবে প্রকাশ্যে রানি সম্পর্কে কোনও কটূকথা অবশ্য বলেননি মেগান। বরং দিদিশাশুড়িকে দেখলে তাঁর নিজের ঠাকুমার কথা মনে পড়ে বলেই জানিয়েছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, ঠাকুমার সঙ্গে মিলিয়ে নিজের মেয়ের নাম ‘লিলিবেট’ রাখেন। সেসব দেখলে ‘শার্লি এবদো’র কার্টুনকে অতিরঞ্জন বলেই মনে হয়।
ক্যামিলা ও এলিজাবেথ
তিনি ডাচেস অফ কর্নওয়াল। চার্লস ও ডায়নার বিচ্ছেদের ‘কারণ’ ধরা হয় ক্যামিলা পার্কার বোলসকে। ডায়নার মৃত্যুর আট বছর পরে ২০০৫ সালে ক্যামিলাকে বিয়ে করেন চার্লস। এই বিয়ে মোটেই মেনে নিতে পারেননি রানি এলিজাবেথ। কিন্তু জীবনসায়াহ্নে এসে ২০২২ সালে তিনি জানিয়ে দেন, ডাচেসকে কুইন কনসর্ট হিসেবে ঘোষণায় তাঁর আপত্তি নেই। আসলে দুঃসময়ে ছেলে চার্লসের পাশে ক্যামিলা যেভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তা দেখে একেবারে শেষে এসে মন গলেছিল রানির। এলিজাবেথের মৃত্যুর পরে মসনদে চার্লস। আর ক্যামিলা হচ্ছেন নতুন রানি।
কেট মিডলটন ও এলিজাবেথ
ডাচেস অফ কেমব্রিজ কেট মিডলটনের সঙ্গে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সম্পর্ক ছিল দারুণ। ২০১১ সালে প্রিন্স উইলিয়ামসের বিয়ে হয়। তারও তিন বছর আগে উইলিয়ামের তুতো ভাই পিটার ফিলিপসের বিয়ের সময়ই কেটের সঙ্গে রানির প্রথম পরিচয়। একেবারে শুরু থেকেই তাঁকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছিলেন তিনি। রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ এক সূত্রের দাবি, রানির ধারণা ছিল তাঁর অবর্তমানে রাজপরিবারের নানা সমস্যায় তাঁর এই নাতি ও নাতবউ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন। তাঁর ভরসা এতটাই ছিল, ভাষণ দেওয়ার আগে নাকি সেবিষয়ে আলোচনাও করে নিতেন কেটের সঙ্গে। এমনকী এমনও বলা হয়, এলিজাবেথ কেটের মধ্যে ভবিষ্যতের ‘রানি’কে দেখতে পেয়েছিলেন।
কিন্তু রানির মৃত্যুর পরে কেমন যেন কুয়াশা তৈরি হয়েছে তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে। যখন রাজপরিবারের সকলে স্কটল্যান্ডে দৌড়চ্ছেন, কেট জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ইংল্যান্ডেই থাকছেন। তাঁর তিন সন্তানের সঙ্গে। কেননা নতুন স্কুলে সবেমাত্র ক্লাস শুরু হয়েছে তাদের। এই অবস্থায় এখানেই থাকতে চান কেট। একথা জানার পরেই শুরু হয়েছে গুঞ্জন। তবে কি কেট ও এলিজাবেথের তথাকথিত ‘সুসম্পর্কে’র আড়ালেও ছিল কোনও ‘অন্য’ কিছু? সেই চেনা শাশুড়ি (এক্ষেত্রে দিদিশাশুড়ি) ও বউমার ঠান্ডা ‘লড়াই’? প্রশ্নগুলো সহজ নয়। উত্তরও অজানাই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.