সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: বাদুড় (Bat) বললে প্রথমেই কী মনে পড়ে? অন্ধকার রাতে সাদা ধবধবে চাঁদের শরীর জুড়ে উড়ন্ত কালো ছায়া। ভ্যাম্পায়ারের অতিলৌকিক জগৎ। কিংবা যদি আপনি ডিসি কমিকসের ভক্ত হন, তাহলে অবশ্য মনে পড়বে অপরাধ দমনে জীবন উৎসর্গ করা ব্যাটম্যানকে। কিন্তু এসবই তো গল্পকথা। সত্যি সত্যিই কিন্তু জাপানের আকাশ থেকে মৃত্যুর মতো নেমে আসার কথা ছিল সারি সারি বাদুড়দের। বাদুড় নাকি মৃত্যুদূত? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এমনই পরিকল্পনা ছিল মার্কিনিদের। যদিও এই মোক্ষম তুরুপের তাসটি আর খেলতে হয়নি। ম্যানহাটন প্রোজেক্টের সাফল্যে হিরোসিমা নাগাসাকিতে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছিল, সেকথা নতুন করে বলা প্রয়োজনহীন। কিন্তু যদি ইতিহাস অন্যদিকে বাঁক নিত? তাহলে সত্যি সত্যিই আকাশ থেকে সারি সারি বাদুড়কে নেমে আসতে দেখা যেত। যারা একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ছারখার করে দিত আস্ত শহর! এই লেখায় আমরা ফিরে দেখব বাদুড় বোমা (Bat bombs) নামের সেই আশ্চর্য অস্ত্রকে।
কী করে এমন এক আজব অস্ত্রের পরিকল্পনা করেছিলেন সেদিনের মার্কিন যুদ্ধবাজরা? কেনই বা তা কার্যকর করা হয়নি শেষ মুহূর্তে? সেকথা বলার আগে একটা কথা বলা দরকার। বাদুড় বোমা কোনও বিক্ষিপ্ত উদাহরণ নয়। ‘অ্যান্টি ট্যাঙ্ক ডগ’ তথা ট্যাঙ্ক ধ্বংসকারী কুকুর কিংবা ‘প্রোজেক্ট পিজিওন’ তথা পায়রার সাহায্যে শত্রুঘাঁটিতে বোমা ফেলার মতো আরও নানা রকম আজব ব্যাপার স্যাপারও খুঁজলেই পাওয়া যাবে। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ গোটা পৃথিবীটাকেই চিরতরে বদলে দিয়েছিল। সমাজ থেকে শুরু করে মূল্যবোধ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি- সর্বত্রই এক চিরস্থায়ী পরিবর্তনের জলছাপ। পুরনো পৃথিবীটাই যেন বদলে যাচ্ছিল। আর সেই প্রভাব পড়ছিল রণকৌশলেও।
১৯৪১ সালে জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণের পরে প্রতিশোধ নিতে ছটফট করছিল আমেরিকা। তারই সুদূরপ্রসারী ফলাফল ১৯৪৫ সালের পরমাণু বোমা হামলা। তার আগে টোকিওয় ‘ডুলিটল রেইড’। তবে সেই হামলার পাশাপাশি নিত্যনতুন অস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছিলই। আর সেভাবেই উঠে এসেছিল বাদুড় বোমার আইডিয়া।
আমেরিকার বিখ্যাত কার্লসবাড ক্যাভার্নে ছুটি কাটাচ্ছিলেন জনপ্রিয় দাঁতের ডাক্তার লিটল এস অ্যাডামস। সেই সময়ই তাঁর নজর পড়ে সেখানকার বিভিন্ন গুহায় ঝুলে রয়েছে প্রায় ৯০ লক্ষ বাদুড়! তারিখটা কাকতালীয় ভাবে ৭ ডিসেম্বর। সেদিনই ঘটেছিল পার্ল হারবারের সেই হামলা। অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারান সেই ঘটনায়। এর আগে পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি আমেরিকা। কিন্তু ওইদিনের পর থেকে তারাও নেমে পড়ে যুদ্ধে। আর তখন থেকেই শুরু হয় পরিকল্পনা। কী করে শিক্ষা দেওয়া যায় জাপানকে।
কিছুদিনের মধ্যেই অভিনব বাদুড় বোমার নীল নকশা জমা পড়ে মার্কিন প্রশাসনের কাছে। লিটল এস অ্যাডামসের সেই আইডিয়া অনুমোদনও পেয়ে যায় ন্যাশনাল রিসার্চ ডিফেন্স কমিটির। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সবুজ সংকেত পেতেই এই প্রোজেক্টের নাম দেওয়া হয় ‘প্রোজেক্ট এক্স রে’।
ঠিক কীরকম ছিল পরিকল্পনা? বাদুড় তার ওজনের দ্বিগুণ ওজনের পদার্থ বহন করতে সক্ষম। ফলে ২ আউন্স ওজনের বোমাকে বুকে আটকে দিলেও তাদের উড়তে অসুবিধা হবে না। তাই ভারী বোমা তাদের বুকের পাতলা চামড়া ও বর্ধনশীল চামড়ায় আটকে দেওয়া হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, আইস বক্সের ট্রে-তে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেঁধে সেখানেই রাখা হয় বাদুড়দের। পরিকল্পনা, এরপর বিমান থেকে কাঠের বাক্সে তাদের বয়ে এনে নিচে ফেলে দেওয়া হবে। এরপর মাটির কাছাকাছি পৌঁছে গেলে অর্থা ১ হাজার ফুটের মধ্য়ে চলে এলেই বাক্স খুলে যাবে। আর তার ভিতর থেকে সদ্য ঘুম ভাঙা বাদুড়গুলি দল বেঁধে উড়তে শুরু করবে। এরপর তারা মাটিতে নেমে এলেই একে একে বিস্ফোরণ ঘটতে থাকবে। রাতারাতি শহরটি দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে। জাপানের কাঠের শহর ও অন্যান্য পরিকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাবে অনায়াসে। এক্ষেত্রে যেটা লক্ষণীয়, কেবল ধ্বংসলীলাই নয়। সেই সঙ্গে অস্বাভাবিক হাতিয়ার প্রয়োগ করে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়াও লক্ষ্য।
১৯৪৪ সাল। পুরোদস্তুর পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পূর্ণ হয় সেই বছরই। তবু শেষ পর্যন্ত এমন এক অদেখা আতঙ্কে জাপানের আকাশে ভাসিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছিল আমেরিকা। কিন্তু কেন? আসলে পরিকল্পনা করলেই তো হল না। প্রয়োজন তার বাস্তব প্রয়োগ। ঠিক যেমন অ্যান্টি ট্যাঙ্ক ডগের ক্ষেত্রেও হয়েছিল। দেখা গিয়েছিল কুকুরকে যতই প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক না কেন, তারা কিছুতেই লক্ষ্যভেদ করতে পারছে না। হয় বোমা শরীর থেকে না খুলেই ফিরে আসছে। নয়তো ঠিক জায়গায় বোমাটি ফেলতে পারছে না।
একই অবস্থা হয়েছিল বাদুড় বোমার ক্ষেত্রেও। দেখা যাচ্ছিল, কখনও কখনও শীতঘুম ভেঙে বাদুড়দের জাগিয়ে তোলায় সমস্যা হচ্ছে। আবার স্ত্রী বাদুড়রা গর্ভবতী হয়ে পড়লে তাদের তো বটেই, পুরুষ বাদুড়দেরও কাজে লাগানো কঠিন। সেই হিসেবে বছরে পাঁচ মাসের মধ্যেই যা করার করতে হবে। আবার ঠিক জায়গায় লক্ষ্যভেদেও সমস্যা হচ্ছিল। একবার তো পরীক্ষা করতে গিয়েই এক সেনানায়কের গাড়িতে আগুন লেগে গিয়েছিল। তাছাড়া একসঙ্গে অসংখ্য বাদুড় বোমা প্রস্তুত করাও বেশ সময়সাধ্য ব্যাপার। তাই সবদিক বিবেচনা করে শেষ মুহূর্তে এই বোমাকে যুদ্ধে ব্যবহার করা থেকে সরে আসে আমেরিকা। তবে এও মনে করা হয়, ততদিনে পরমাণু বোমা তৈরির ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। তাই শেষ পর্যন্ত হিরোসিমা-নাগাসাকির ধ্বংসলীলার দিকে যায় ইতিহাস।
তবে বাদুড় বোমার পরিকল্পনা বিশ্ব জেনেছিল অনেক পরে। গত শতকের সাতের দশকে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত এক মার্কিন নথি থেকে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। সেই থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার এক বিকল্প-ইতিহাসের সম্ভাবনা সভ্যতার আয়নায় জাগিয়ে রেখেছে বাদুড় বোমার ইতিহাস। যে ইতিহাস আরও একবার মনে করিয়ে দেয় নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে যেভাবে মারণাস্ত্র তৈরিতে মন দিতে দেখা গিয়েছে মানুষকে, তা প্রমাণ করে দেয় পশুকে হিংস্র বলে দেগে দেওয়াটা এক মহাভুল। পৃথিবীতে হিংস্রতায় মানুষের সমকক্ষ কেউই নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.