বিশ্বদীপ দে: ”তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল?” গুপি-বাঘার গানের ধাক্কায় হাল্লা রাজার সেনারা থমকে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, যুদ্ধের নেশাকে অত সহজে দমানো যায় না বাস্তব দুনিয়ায়। তাই দেখতে দেখতে দুবছর পেরিয়েও রাশিয়া ও ইউক্রেনের (Ukraine) মধ্যে যুদ্ধ অব্যাহত! ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি হাজারে হাজারে রুশ সেনা যখন এগিয়ে গেল ইউক্রেনের দিকে, গোটা পৃথিবী সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। তার পর এতগুলো সপ্তাহ, মাস, বছর ঘুরেও যুদ্ধের বারুদের গন্ধে একই রকম ভারী কিয়েভের আকাশ। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, কবে থামবে এই লড়াই।
সময়টা বড় ভয়ংকর। গাজা ভূখণ্ডে ইজরায়েলি সেনার সঙ্গে হামাসের সংঘর্ষ চলছে। যুদ্ধের কালো মেঘ ছড়িয়েছে অন্যত্রও। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের (Russia-Ukraine) তাৎপর্য আলাদা। আসলে প্রতিটি লড়াইয়ের অভিমুখই পৃথক। পশ্চিমের সঙ্গে বহির্বিশ্বের লড়াই বলে যতই দেগে দেওয়া হোক, আসলে এই যুদ্ধের প্রেক্ষিত আরও গভীর। আর এই যুদ্ধ শেষ হওয়া কেবল ইউক্রেন নয়, ভারত বা এশিয়ার অন্য দেশগুলি সর্বোপরি পৃথিবীর জন্য জরুরি বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। যে লেখাটি লিখেছেন দিমিত্রো কুলেবা ও জোসেপ বোরেল। প্রথম জন ইউক্রেনের বিদেশমন্ত্রী। দ্বিতীয় জন ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক প্রতিনিধি। তাঁদের যৌথ কলমে লেখা প্রতিবেদনটিতেও একই দাবি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই যুদ্ধের সমাপ্তির দিকে তাকিয়ে রয়েছে গোটা বিশ্বই। তাঁদের দাবি, উনবিংশ শতাব্দীর মতো ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী ঢঙে এই যুদ্ধ করছে পুতিনের দেশ। আর তার জেরে ইউরোপ জুড়েই এহেন লড়াইয়ের বিষণ্ণ বাস্তবের ছায়া। বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে কোনও যুদ্ধেই এত প্রাণহানি ও ধ্বংসলীলা আর কখনওই হয়নি। যে যন্ত্রণা ইউক্রেনকে ভুগতে হচ্ছে তা অতীতে অনেক দেশই ভোগ করেছে। পাশাপাশি সেখানে আরও বলা হয়েছে, পুতিন (Vladimir Putin) নির্দেশিত এই যুদ্ধলীলার উদ্দেশ্য এক স্বাধীন দেশকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া!
এই লেখা যেহেতু ইউক্রেনের বিদেশমন্ত্রী ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি লিখেছেন, তাই স্বাভাবিক মনে হবেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাঁদের এই বিষোদ্গার। কিন্তু সেই ‘পক্ষপাতিত্ব’ তাঁদের লেখাকে যুক্তিহীন করেছে এটা মোটেই বলা যায় না। বরং যে যুক্তিতে লেখাটি প্রতিষ্ঠিত, তাকে খণ্ডন করা কঠিন। সেকথা বলার আগে একবার ইতিহাসটা দেখা দরকার। পূর্ব ইউক্রেনে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে ‘রাশিয়ার (Russia) মদতপুষ্ট’ বিদ্রোহীদের লড়াই চলছিলই। কিন্তু পরিস্থিতি সবচেয়ে গুরুতর হয়ে ওঠে ২০১৪ সালের পর থেকে। সেবারের নির্বাচনে ইউক্রেনের নাগরিকরা রুশপন্থী এক নেতাকে দেশের সর্বোচ্চ পদ থেকে সরিয়ে দেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। ব্যাপারটা একেবারেই ভালো ভাবে নেয়নি রাশিয়া। ক্রিমিয়া দখল করে মস্কো। যদিও তাদের উপরে এরপরই একগুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা জারি করে আমেরিকা। কিন্তু রাশিয়া তাদের ‘রণং দেহি’ হাবভাব বদলানোর কোনও চেষ্টাই করেনি। উলটে নতুন করে মদত জুগিয়ে গিয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের। সেই বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্যই ছিল, পূর্ব ইউক্রেন দখল করে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করা। যা দেখে অসন্তোষ বাড়তে থাকে ইউক্রেন প্রশাসনের। এর পরই তারা দ্বারস্থ হয় ন্যাটোর। আর এখান থেকেই ব্যাপারটা এক অন্য দিকে বাঁক নেয়।
অবশেষে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। যার ক্ষেত্রে পুতিন সরকারের যুক্তি, প্রতিরক্ষার কৌশলগত কারণেই ইউক্রেন দখল করে পূর্ব ইউরোপ ও নিজেদের মধ্যে একটি ‘বাফার জোন’ তৈরি করতে চায় তারা। আর সেই কারণেই যেনতেন প্রকারেণ ইউক্রেনকে দখলে রাখতে এই যুদ্ধ চালাচ্ছে রাশিয়া। কিন্তু লক্ষ্য যাই থাক, আধুনিক বিশ্বের কি সত্যিই এমন যুদ্ধ প্রাপ্য ছিল?
গত শতাব্দী দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে। সেই মহাযুদ্ধের অভিঘাত যুদ্ধশেষের পরও দশকের পর দশক জুরে জারি থেকেছে। বহু কিছু বদলে গিয়েছে চিরকালের মতো। আর্থ-সামাজিক হোক বা রাজনৈতিক সমীকরণ, সবক্ষেত্রেই পরিবর্তন এসেছে। এই পরিস্থিতিতে ফের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কি শান্তিকামী মানুষ চাইতে পারে? কারণ, যে কোনও যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সাধারণ মানুষের। রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘর্ষে এই দুই বছরের সংঘাতে সাধারণ মানুষকে কতটা বিপণ্ণ হতে হয়েছে, তা বুঝিয়ে দিয়েছে ‘পাখির চোখে’ দেখা চিত্র। বাখমুট হোক কিংবা ফেওডসিয়া, আভডিভকার মতো প্রদেশের ছবিতে দেখা যাচ্ছে সবুজে ঘেরা জনবসতিগুলো ধূসর জনহীন প্রান্তরে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধের ‘ক্যানসার’ কীভাবে সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেয়, সেই করুণ বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলছে উপগ্রহের তোলা নানা ছবি। জনবহুল এলাকাগুলো আজ শ্মশানভূমি। পর পর দাঁড়িয়ে থাকা ঝলসানো বাড়ি। ভাঙা দেওয়াল, পলেস্তরা খসে পড়া ধ্বংসাবশেষের দিকে দেখলে বোঝা যায়, যুদ্ধের ভাইরাস কত দূর পর্যন্ত কুরে কুরে খেয়ে নিতে পারে সভ্যতাকে।
এহেন যুদ্ধ কেবল সংশ্লিষ্ট দেশটিকেই নয়, প্রভাবিত করে অন্যান্য দেশগুলিকেও। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশেরই এতে স্বার্থ জড়িত। তাই যুদ্ধের সমাপ্তি চায় তারাও। সামগ্রিক ভাবে দেখলে গোটা বিশ্ব বাজারেই গত দুবছর ধরে ছড়িয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। মনে রাখতে হবে, ইউক্রেন বিশ্বের খাদ্যশস্য়ের এক গুরুত্বপূর্ণ ভাণ্ডার। সরবরাহের হিসেবে বিশ্বের প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যেই রয়েছে তারা। এহেন এক দেশের যুদ্ধকবলিত হওয়া কেবল সেদেশের সমস্যা নয়। হতে পারে না। কাজেই মানবিক দিক থেকেই হোক কিংবা নিজ নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রসঙ্গেই হোক, বিশ্বের বড় অংশের দেশই এই যুদ্ধের সমাপ্তি চায়। এবং তা ইউক্রেনের অনুকূলে। রাশিয়া-বিরোধী না হয়েও চায়। কিন্তু চাইলেই কি সব সময় তা মেলে? কবে মুক্তি মিলবে যুদ্ধের বিষ-নিশ্বাস থেকে? প্রশ্নগুলো সহজ। কিন্তু উত্তর এখনও জানা নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.