তরুণকান্তি দাস: আফটার শক! রোজ কাঁপছে নেপাল৷ আর ভয়ে ঘর ছাড়ছেন একের পর এক নেপালবাসী৷ এবং অধিকাংশের গন্তব্য এখন কলকাতা৷ যাকে ঘরের পাশের ঘর বলে আঁকড়ে ধরছেন তাঁরা৷ গত কয়েকমাস ধরে এটাই নেপালের ট্রেন্ড৷ যা সামলাতে হিমশিম কলকাতায় অবস্থিত নেপাল কলস্যুলেটের অফিস৷ এবং এখানকার ভারতীয় দূতাবাস৷ কেন না কলকাতায় পাকাপাকি আস্তানা চেয়ে নাগরিকত্বের জন্য দরবার চলছে যে!
গত বছর এপ্রিলের ভূমিকম্পে নেপালের যেন অর্থনৈতিক পাতাল প্রবেশ ঘটেছে৷ এখানে যার নাম, ‘গোর্খা কম্পন’, তার জেরে কাঠমান্ডু ভ্যালি থেকে দরবার স্কোয়ার, একের পর এক দর্শনীয় বিশ্বমানের স্থাপত্যের ধ্বংস দেখেছে দুনিয়া৷ প্রায় আট হাজার মানুষের মৃত্যুতে নেপালবাসী হারিয়েছেন পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন৷ আর এখন কেউই যেন আস্থা রাখতে পারছেন না প্রকৃতির উপর৷ যে প্রকৃতির ধ্বংসলীলার ছাপ কাঠমান্ডুর পরতে পরতে৷ কোথাও শহরের শরীরে, কোথাও বা শহরবাসীর মনে৷ সগরমাতার কোলে শান্ত-স্নিগ্ধ দ্বিতীয় ‘সুইজারল্যান্ড’ হিসাবে পরিচিত এ কোন নেপাল! প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ভারাক্রান্ত মুখ এখানকার সরকারি আধিকারিক থেকে কোনওক্রমে এখনও সরকারি-বেসরকারি শিবিরে দিন গুজরান করা মানুষের৷ যাঁদের ট্রমা এখনও কাটেনি৷
তারই মধ্যে উঠে আসছে এক অবাক করা তথ্য৷ গত বছর এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত ১৭০০ বার কেঁপেছে হিমালয়ের কোলঘেঁষা দেশটি৷ এখানকার খনি ও ভূতত্ত্ব দফতরের মুখপাত্র কৃষ্ণদেব ঝা বলছেন, “এমনও হয়েছে একদিনে ১০ থেকে ১২ বার ভূমিকম্প ধরা পড়েছে৷ মাত্রা বেশি নয় বলেই রক্ষা পেয়ে যাচ্ছি৷” কিন্তু ঘর ছাড়ছেন নেপালের বহু মানুষ৷ এবং অবশ্যই এখানে ব্যবসা অথবা নানা কারণে দীর্ঘদিন ঘাঁটি গেড়ে করে-কম্মে খাওয়া লোকজনও৷ বিশেষ করে যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে, তাঁদের সংখ্যাই এ ক্ষেত্রে বেশি৷ তবে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো তথ্য হল, এঁদের অধিকাংশের প্রথম পছন্দ পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে কলকাতা৷ যে শহরকে তাঁরা বলছেন, “সস্তা ও নিরাপদ”৷
সত্যিই তাই, নিউ আলিপুরে যে পরিবারটি ঘাঁটি গেড়েছে তাঁদের ছেলে থাকেন আমেরিকায়৷ আপাতত বাবা-মাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না৷ তাই নেট ঘেঁটে কলকাতাকেই আপাতত নিশ্চিত ঠাঁই বলে মনে হয়েছে তাঁর৷ কলকাতায় নেপাল কনস্যুলেটের দ্বারস্থ হন তিনি৷ সেখানকার এক কর্মী আপাতত এগারো মাসের চুক্তিতে ঘরভাড়া করে দিয়েছেন তাঁদের জন্য৷ স্বামী-স্ত্রী সেখানেই রয়েছেন৷ আর একটি পরিবার আস্তানা গেড়েছে সল্টলেকে৷ তাঁর মেয়ে এখনও থাকেন নেপালে৷ তবে মাঝেমধ্যে কলকাতা যাচ্ছেন৷ দেখভাল করছেন৷ প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে ফিরছেন৷ অপেক্ষায় রয়েছেন নিজের দেশের জমিবাড়ি বিক্রি করে টাকা পয়সা নিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলার৷
কান্তাপ্রসাদ ছেত্রী, কমল নারায়ণ, প্রেমা বাহাদুররা কেউ থাকেন বাইপাসের ধারে ফ্ল্যাট ভাড়া করে৷ কারও আস্তানা বিমানবন্দরের অদূরে মাইকেলনগর৷ কান্তাপ্রসাদ যেমন ফোনে বলেছেন, “জন্মভিটে-মাটি ছেড়ে আসতে কারই বা ভাল লাগে বলুন৷ কিন্তু কী করা যাবে? আমার মেয়ে চাকরি করে নেপালে৷ এখন পাত্র খুঁজছি কলকাতায়৷ নেপালের যাঁরা এখানে থাকেন, তাঁদের পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিলে ওখানকার সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে আসবে৷” অনেকে নেপালের নাগরিকত্ব ছাড়তে চেয়ে আবেদন জানিয়েছেন৷ কেউ চান ভারতের নাগরিকত্ব৷
কাঠমান্ডুর থামেল শহর হল সবচেয়ে অভিজাত এলাকা৷ সেখানে ঠিক কতদিন আগে তাঁর পূর্বপুরুষরা এসে জমিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তা মনে করতে পারেন না শিউজি কেলকর৷ শুধু এখন বলতে পারছেন, “ছেলেটাকে মুম্বই পাঠিয়ে দিয়েছি৷ পড়াশোনা করুক৷ যদি ইন্ডিয়াতে একটা কিছু করতে পারে৷ আমাদের আর ক’দিন? আর এখানে তো রোজ কাঁপুনির দিন গোনা৷ কতদিন আর এভাবে চলবে?” বজং, কালিকট, দোজাখা, লামজুং, সিন্ধুপালচকে কাঁপুনির জেরে নতুন নির্মাণ দূরে থাক, ভেঙে পড়া বাড়ি মেরামতেও সাহস পাচ্ছেন না কেউ৷ তাঁদের কাছে বিদেশ না হোক স্বদেশেই অন্য কোথাও, অন্য কোনও নিরাপদস্থান এখন আপাত-গন্তব্য৷
সত্যিই! কাঁপুনির নেপালে ঘরছাড়ার জ্বর যেন জাঁকিয়ে বসেছে!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.