সুদেষ্ণা মিত্র, ওয়াশিংটন ডিসি: হঠাৎ করে কয়েক দিনের মধ্যেই কেমন অচেনা হয়ে গেল আমার এই চেনা জায়গাটা। কর্মসূত্রে বহু বছর আমি এই মার্কিন মুলুকে। মাস্টার্স করার জন্য এসেছিলাম। তার পর পিএইচডি, পোস্ট ডক্টরাল করে এখানেই থেকে গিয়েছিলাম। পরে আবার বেশ কিছু দিনের জন্য দেশে যাই। এই দীর্ঘ সময়ে এই দেশটার যে জিনিসটা বারবার চোখে পড়েছে তা হল এই দেশটার প্রাণশক্তি। কত কিছুর পরও না মরে ফের মাথা তুলে বেঁচে ওঠে। ৯/১১’র পরও ঠিক এমনটাই হয়েছিল। কিন্তু এই গত সপ্তাহ দু’য়েকের মধ্যে চেনা শহরটা পালটে গিয়েছে। চেনা দেশটাও।
গত প্রায় বছরখানেক আমি একটা প্রজেক্টের কাজে ওয়াশিংটন ডিসিতে বাস করছি। রোড সেফটি নিয়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটা চার বছরের কাজে এসেছি। দিনদশেক আগেও আমাদের কমপ্লেক্সের সামনে যে রেস্তোরাঁগুলো ছিল সেখানে রীতিমতো লোকজনের ভিড়। গত উইক এন্ড থেকে সেখানে লোকজন দেখতে পাচ্ছি না। এটা ভীষণ অস্বাভাবিক ঠেকছে চোখে। আসলে এই মাইগ্র্যান্টদের আবাসভূমি হিসাবে গড়ে ওঠা গোটা আমেরিকা দেশটাই খুব হুজুগে। সপ্তাহশেষে হট্টগোল না করলে পরের সপ্তাহজুড়ে কাজ করার এনার্জি পায় না এরা। এক সপ্তাহ আগেও এখানে ভাল ভিড় থাকলেও আগের শুক্র-শনিবারে এখানে কোনও ভিড় ছিল না। একই সঙ্গে এরা ভীষণ স্বাস্থ্য নিয়ে বাতিকগ্রস্ত। মানে সকালে শরীরচর্চা হয়তো সকলে করে না। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে, এই বিষয়টা নিয়ে সকলে ভীষণ প্যানিক করে। সেই কারণে এদের করোনা নিয়ে এতটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
সপ্তাহখানেকের বেশি হয়ে গেল আমাদের বলে দেওয়া হয়েছে বাড়ি থেকেই কাজ করতে। প্রতিটি কর্মীকেই তাই বলে দেওয়া হয়েছে। তেমনটাই চলছে। আসলে আমাদের ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের দপ্তর হোয়াইট হাউসের দুটো ব্লক পরেই। ফলে অনেক বেশি সাবধানতা নিতে হচ্ছে সেখান থেকে। আমার মেয়ে এবং স্বামী দু’জনেই এখন বাড়িতে। ভারতে আমি ও আমার স্বামী নীলাঞ্জন মিত্র, দু’জনেই খড়গপুর আইআইটিতে অধ্যাপনা করি। দু’জনেই এখন কয়েক বছরের জন্য এ দেশে এসে রয়েছি। নীলাঞ্জনের জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি এখন পুরোপুরি বন্ধ। আমার মেয়ের স্কুলও। তবে মেয়ের কিন্তু ক্লাস বা পড়াশোনা এতটুকু বন্ধ নেই। আমার মেয়ে মিহিকা ক্লাস ফাইভে পড়ে। ওদের প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সকাল আটটা থেকেই অনলাইনে ক্লাস করতে বসতে হচ্ছে। মেয়ের অবশ্য তাতে এতটুকু সমস্যা নেই। অসুবিধাটুকু শুধু এটাই যে, মাঝেমাঝেই ঘুরতে বেরনোর সুযোগ মিলছে না।
ভারতে এখন গোটা দেশ লকডডাউন। ওখানে আমার বাবা-মা এবং শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন। তাঁদের সঙ্গে ফোনে নিয়মিত কথা হলেও চিন্তাটা তো রয়েছেই। বয়স্ক মানুষগুলো কীভাবে নিজের দেখভাল করছে, আদৌ ঠিকমতো করতে পারছে কি না বুঝতে পারছি না। প্রয়োজনে যে সমস্ত জায়গা থেকে সহযোগিতা পাওয়ার কথা তার সঙ্গেও সংযোগ নেই বলছেন ওঁরা। এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও সমস্যা হয়নি, কিন্তু হলে কী হবে জানি না।
ইন্টারনেটের সুযোগে দেখতে পাচ্ছি, ভারতে বহু জায়গাতেই মানুষ আইন ভেঙে বাইরে আসছেন। জানি না এই সময়ে কলকাতায় থাকলে আমরা কী করতাম। আমার বাবা এবং শ্বশুরমশাইও তো শুরুর দিকে বিষয়টার গুরুত্ব না বুঝে বাইরে বেরিয়ে পড়ছিলেন। এখন কিছুটা সাবধান হয়েছেন। কিন্তু আমেরিকায় নিয়ম মানাটা ভীষণরকম বাধ্যতামূলক। নিয়ম ভাঙার শাস্তি ভয়ংকর হতে পারে। মানুষগুলো হয়তো একটু নিয়মের বাড়াবাড়ি করে, কিন্তু গোটা সিস্টেমকে সচল রাখতে সেটাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি দরকার। শেষ পর্যন্ত খবর পেয়েছি যে, এখনই এই দেশে বহু মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। সঠিক অঙ্কটা কত জানি না। তবে দীর্ঘ সময় এখানে থাকার সুবাদে বুঝতে পারছি, কঠোর ডিসিপ্লিনই আবার এদের মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। করবেই। প্রার্থনা করছি বহু হাজার মাইল দূরে আমার দেশটাও এমনভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াক।
(লেখক খড়গপুর আইআইটির অধ্যাপক, বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পথ নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.