সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: কথায় কথায় বাংলার মধ্যে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে ইংরেজি। প্রয়োজনে নয়, অদরকারেই। এ ধরনের কথা বলা যেন এখনকার সময়ে একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকী এই জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলছেন বেতার উপস্থাপক বা রেডিও জকিরাও। এবার তা বন্ধ করতেই উদ্যোগী হল বাংলাদেশ। সে দেশের তথ্যমন্ত্রকের তরফে রাষ্ট্রমন্ত্রী তারানা হালিম রীতিমতো নির্দেশিকা পাঠিয়েই আরজে-দের শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন।
[ বিজ্ঞাপনে বিকৃত বাংলা, এয়ারটেলের কানেকশন ছাড়লেন এই বাঙালি ]
বাংলাদেশের একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক তথ্যমন্ত্রী তারানা হালিম জানিয়েছেন, উপস্থাপকদের যে সাধু ভাষায় কথা বলতে হবে তার কোনও মানে নেই। সাধারণভাবে যেভাবে বাংলায় কথা বলা হয়, সেভাবেই যেন কথা বলেন তাঁরা। অকারণে বাংলার মধ্যে ইংরেজি শব্দ না ঢুকিয়ে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাঁর কথায়, যাঁরা এই জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলছেন, তাঁরা শুদ্ধ ইংরেজিতে বা শুদ্ধ বাংলায় একটি কথা বলতে পারবেন কিনা সন্দেহ। সুতরাং এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার। ভাষারক্ষায় বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। বস্তুত ভাষার প্রতি এই ভালবাসাই একদা মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপণ করেছিল। যা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতা এনে দেয়। জন্ম হয় স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। সেই ট্র্যাডিশন আজও শেষ হয়নি। সময়ের বদলে বেনোজল ঢুকেছে ঠিকই। কিন্তু সঠিক সময়ে তাতে রাশ টেনে দৃষ্টান্ত তৈরি করল বাংলাদেশ।
[ এরকম ভুল ভবিষ্যতে হবে না, ক্ষমা চেয়ে বলল এয়ারটেল ]
প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশ যদি পারে, তাহলে ভারত কি পারে না? বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ? এ বাংলাতেও বহু রেডিও স্টেশনে আরজে-রা ‘বাংরেজি’ ভাষাতেই কথা বলেন। এবং তা রীতিমতো ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। যেন এভাবে কথা বলাই দস্তুর। বলা বাহুল্য, তরুণ প্রজন্মও সেই পথ অনুসরণ করে বাংরেজি মেশানো ভাষাতে কথা বলতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তকে তাই কীভাবে দেখছেন এই বাংলার আরজে-রা? জনপ্রিয় আরজে রাজা জানালেন, “শুধু আরজে কেন, বাংরেজি নিয়ে যে কোনও বাংলা বলা মানুষেরই সতর্ক হওয়া উচিত। বাংলা বা ইংরেজি, যেটাই বলা হোক যেন শুদ্ধভাবে বলা হয়। অনেক ইংরেজি শব্দ বাংলার মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। যেমন, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি। এখন এভাবে চাল থেকে কাঁকর বাছতে শুরু করলে যা দাঁড়াবে, সেটা একটা সাজানো ভাষা হবে। ঠিক আমাদের মুখের ভাষা হবে না। আমি এমন শুদ্ধ ভাষায় কথা বললাম যে সেটা বোঝাই গেল না। তার যেমন দরকার নেই, তেমনই বাংরেজি বলতে যা বোঝানো হয়, সেটাও কিন্তু কখনওই কাম্য নয়। আসলে মাপটা জানতে হয়। নাহলেই মুশকিল। অনেক সময় বাংলাতেই একটা কথা বলা হয়, কিন্তু তার উচ্চারণ হয় হিন্দি বা ইংরেজির মতো। তাতেও আখেরে বাংলা ভাষার সৌন্দর্যই নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি একটা হোর্ডিংয়ে যখন ভুল বাংলা বানান থাকে, তাও কিন্তু একইরকম ক্ষতি করছে। এই সব নিয়েই আমাদের আরও সচেতন হওয়া উচিত।”
[ ‘ইংরাজি নয়, মাতৃভাষায় বেশি করে কথা বলুন ভারতীয়রা’ ]
আর এক জনপ্রিয় আরজে শ্রী জানালেন, “বাংলাদেশ তো ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। ওখানে ভাষার জন্য আবেগটাই আলাদা। আমাদের রাজ্যের নামে বাংলা থাকতে পারে, কিন্তু ভাষার জন্য সেই ভালবাসা নেই। উলটে এখানে বাংলাটা বলতে না পারলে লোকে বেঁচে যায়। বা বাংলা বলতে না পারার জন্য লজ্জিত হওয়া দূরের কথা, গর্ববোধ করেন। আমি তাই বলি, এ ধরনের সিদ্ধান্ত যদি আমাদের এখানে কার্যকর করতে হয়, তবে শুধু আরজে-দের জন্য নয়, সকলের জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। দক্ষিণ ভারতের মানুষরাও তো দেশের বাইরে নন। তাঁরা তাঁদের ভাষাকে আগলে রাখেন। তাহলে আমাদের ক্ষেত্রেই খালি এ সমস্যা কেন? কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, আমি বাংলাটা বলতে পারি মানে ধরেই নেওয়া ইংরেজিটা তত ভাল বলতে পারি না। আমি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা লঙ্ঘনের পক্ষপাতী নই। কিন্তু তা যদি ভাষার অধিকার নিয়ে হয়, তবে সকলের জন্যই তা বাধ্যতামূলক করা উচিত। কোপ যেন শুধু আরজেদের উপর না পড়ে। কারণ তাঁদের কাজ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা। সুতরাং তাঁদের সে ভাষাটাই বলতে হয়, যেটা তাঁর চারপাশের মানুষ বলছেন। সুতরাং এই সামগ্রিক পরিস্থিতিটাই বদলাতে হবে।”
[ অপমানিত আঞ্চলিক ভাষা! জানেন কী বললেন রাষ্ট্রপতি? ]
এক ভাষার মধ্যে অন্য ভাষার শব্দের মিশে যাওয়া নতুন কিছু নয়। ভাষা বহতা নদীর মতো। তাতে এই মিশ্রণ থাকেই। আদতে তা ভাষাকে পুষ্টি জোগায়। সংগীতের মতো ভাষাও ততখানিই খোলামেলা, যা সময়ের বিবর্তনকে আত্মস্থ করে নিতে পারে। তাতেই ভাষার সভ্যতা সচল থাকে। তা নিয়ে দ্বিধার কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে মানসিকতা নিয়ে। যেভাবে অদরকারে ইংরেজি বা হিন্দি মেশানো বাংলা বলাকে রেওয়াজে পরিণত করা হচ্ছে, তাতে বদলে যাচ্ছে ভাষার গঠনতন্ত্র। হিন্দি বা ইংরেজির অনুবাদ বা সেই আদলেই গঠিত হচ্ছে বাংলা বাক্য। বাংলার ক্রিয়াপদ মুখ লুকোচ্ছে। বদলে প্রতিভাত হচ্ছে ‘ভোট করুন’ বা ‘কেন কী’-র মতো শব্দবন্ধ। এমনকী মুখের কথাতেও আজকাল তা ব্যবহৃত হতে হতে প্রায় নির্বিকল্প হয়ে উঠছে। ভাষার আদানপ্রদান ঠিক এ জিনিস নয়। বরং এ যেন সুপরিকল্পিতভাবে ভাষার বুননটাই বদলে দেওয়া। এর প্রতিবাদ যে হয়নি তা নয়। তবে তাতে বদল কিছু আসেনি। যে বাঙালি এয়ারেটেলের ভুল বাংলা নিয়ে প্রতিবাদে সরব হয়, সেই বাঙালি কেন দিনের পর দিন এই প্রবণতাকে মেনে নিচ্ছে, এ প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত। ভাষার সঙ্গে মিশে থাকে জাতি পরিচয়। আঞ্চলিক ভাষা যদি স্বাতন্ত্র হারায় তবে তা সমূহ বিপদ ডেকে আনে। এবার তা রুখতেই সতর্ক হল বাংলাদেশ। আমরা সতর্ক হব কবে?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.