সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ৭ অক্টোবর, ২০২৪-এ ঠিক এক বছর হবে। আচমকা ইজরায়েলে হামলা চালিয়েছিল প্যালেস্তিনীয় জঙ্গি গোষ্ঠী হামাস। ওই হামলায় মৃত্যু হয়েছিল ১২০০ ইজরায়েলি নাগরিকের। আরও ২৫৩ জনকে বন্দি করে হামাস। সেই থেকে নতুন পর্বে প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল সংঘাতে(Israel-Palestine Conflict) রক্ত ঝরা শুরু। পালটা নেতনিয়াহুর ফৌজের হামলায় গাজা স্ট্রিপে মৃত্যু হয়েছে ৪১,৫০০ প্যালেস্তিনীয়র। ২৫ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। যদিও মৃত্যুমিছিল এবং গৃহহীনদের এই পরিসংখ্যান সাম্প্রতিক। ভুলে গেলে চলবে না যে গত সাত দশক ধরে চলছে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাত। বিরোধের শেকড় গাঁথা আছে ইতিহাসের গভীরে। কেমন সেই ইতিহাস?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্যালেস্টাইনের পুরনো ভূখণ্ডে ফিরতে শুরু করে ইহুদিরা। সমর্থন ছিল ব্রিটেন, আমেরিকা-সহ একাধিক দেশের। যদিও শুরু থেকে স্থানীয় আরব মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে বনিবনা হয়নি। এর মধ্যেই ইহুদিরা স্বতন্ত্র ‘নিরাপদ’ দেশগঠনের সংকল্প নেয়। ভারতে যে বছর ব্রিটিশ শাসনের অবসান হবে, সেই ১৯৪৭-এ প্যালেস্টাইনেও ছিল ব্রিটিশ শাসন। রাষ্ট্রসংঘ ঠিক করে আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে প্যালেস্টাইের ভূভাগ দ্বিখণ্ডিত হবে। অন্যদিকে জেরুজালেম থাকবে নিরেপক্ষ আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের শাসনে। স্বভাবতই ইহুদি নেতারা এই পরিকল্পনায় খুশি হন। ৫৬ শতাংশ ভূমি ইহুদিদের দেওয়ার কথা বলা হয়। আরব লিগ এই প্রস্তাব খারিজ করে দেয়।
যদিও শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ইজরায়েলের প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড বেন-গুরিয়েন ১৯৪৮-এর ১৪ মে আধুনিক ইজরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা করেন। একদিন পরেই প্যালেস্টাইনের মাটি ছাড়ে ব্রিটিশ শাসকরা। ডেভিড ঘোষণা করেন—নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা ইহুদিদের জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল ইজরায়েল। উল্লেখ্য, ১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে আরবদের নিজেদের মধ্যেও সহিংসতা তীব্র হয়েছিল। যদিও ১৯৪৮-এ ইজরায়েল তৈরির একদিন পরে পাঁচটি আরব রাষ্ট্রের সেনা হামলা চালায় ইজরায়েলে।
পরবর্তী যুদ্ধের জেরে জর্ডন, লেবানন এবং সিরিয়া এবং গাজার পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে প্রায় ৭ লক্ষ প্যালেস্তিনীয় নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। প্যালেস্তিনীয়রা যাকে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয় বলেন। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তারা বলপূর্বক প্যালেস্তিনীয়দের ভিটেছাড়া করেছে। এর মধ্যে ১৯৪৯ সালে আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও বাস্তব কার্যকারিতা দেখা যায়নি। ফলস্বরূপ বর্তমান ইজরায়েল ভূখণ্ডে আরব জনসংখ্যা মাত্র ২০ শতাংশ।
প্রধান যুদ্ধগুলি:
১৯৪৯ সালের পর ফের ‘৬৭-তে যুদ্ধের মেঘ ঘনিয়ে আসে। ইজরায়েলকে মানচিত্র মুছে ফেলতে সক্রিয় হয় আরব দেশগুলো। নেতৃত্বে ছিল মিশর ও সিরিয়া। তবে ষড়যন্ত্রের আঁচ আগাম হামলা চালায় ইজরায়েল। যা ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ আরবিতে ‘নাকসা’ হিসেবে পরিচিত। এই যুদ্ধেই পশ্চিম তীর, জর্ডন নিয়ন্ত্রিত পূর্ব জেরুজালেম ও সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে ইজরায়েল।
১৯৭৩ সালে মিশর ও সিরিয়া সুয়েজ খাল ও গোলান মালভূমি বরাবর ইজরায়েলি স্থাপনাগুলোয় হামলা চালায়। শুরু হয় ‘ইয়োম কিপপুর যুদ্ধ’। তবে তিন সপ্তাহের মধ্যেই উভয় দেশের বাহিনীকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয় ইজরায়েলি ফৌজ।
১৯৮২ সালে ইজরায়েলি বাহিনী লেবাননে হামলা চালায়। ১০ সপ্তাহের সংঘাতে ইয়াসের আরাফাতের (প্যালেস্টাইনের প্রয়াত নেতা) নিয়ন্ত্রণাধীন হাজারো যোদ্ধাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। ২০০৬ সালে লেবাননের হেজবুল্লা গোষ্ঠী দুই ইজরায়েলি সেনাকে আটক করলে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়।
১৯৬৭ সালে মিশরের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া গাজা উপত্যকা ২০০৫ সালে ছেড়ে দেয় ইজরায়েল। কিন্তু গাজার নিয়ন্ত্রণকারী হামাস গোষ্ঠী রকেট হামলা চালালে ইজরায়েল পালটা বিমানহানা চালায়। এই বিরোধের জের ধরেই ২০০৬, ২০০৮, ২০১২, ২০১৪ ও ২০২১ সালে বড় ধরনের ইজরায়েলি আগ্রাসনের ঘটনা ঘটেছে।
এসব যুদ্ধের বাইরেও ১৯৮৭ সালে থেকে ১৯৯৩ সাল এবং ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্যালেস্তিনীয়দের ডাকা দুটি ‘ইন্তিফাদা’ বা ’ইসলামি জাগরণ’-এর সময় ইজরায়েলিদের বিরুদ্ধে হামাস আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। ‘ইন্তিফাদা’ বলতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, গণবিক্ষোভ, আইন অমান্য, ধর্মঘট ইত্যাদি। যদিও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান বলছে, প্রথম ‘ইন্তিফাদা’র সময় এক হাজারেরও বেশি প্যালেস্তিনীর মৃত্যু হয়। প্রায় পৌনে দুই লক্ষ মানুষকে গ্রেপ্তার হন।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় পদক্ষেপ:
১৯৭৯ সালে মিশর ও ইজরায়েলের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়, যা দুই দেশের মধ্যে তিন দশকের বৈরিতা অবসান ঘটায়।
১৯৯৩ সালে প্যালেস্টাইনে সীমিত সায়ত্বশাসনের বিষয়ে অসলো চুক্তিতে সম্মত হন প্যালেস্তিনীয় নেতা ইয়াসের আরাফাত ও ইজরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন।
১৯৯৪ সালে ইজরায়েল ও জর্ডনের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিড সম্মেলনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক ও প্যালেস্টাইনের ইয়াসের আরাফাত আলোচনায় বসলেও শান্তি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়।
২০০২ সালে আরব দেশগুলোর পক্ষ থেকে ইজরায়েলকে প্রস্তাব করা হয়, সব সেনা প্রত্যাহার করে ১৯৬৭ সালের আগের মানচিত্রে ফিরে যেতে হবে, যার বিনিময়ে ইজরায়েলের সঙ্গে সব আরব রাষ্ট্রের স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন হবে।
২০১৪ সালে ওয়াশিংটনে ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি।
সাম্প্রতিক শান্তি প্রক্রিয়া:
আমেরিকার জো বাইডেন প্রশাসন ইজরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। তবে প্যালেস্টাইন অঞ্চলে নতুন সংঘাতের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশ ইজরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করেছে বা সম্পর্ক ভালো করার প্রক্রিয়ায় মধ্যে রয়েছে, তারা অস্বস্তিতে পড়েছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইন বিরোধের মূল কারণ:
দুই রাষ্ট্র সমাধান, ইজরায়েলি বসতি, জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ, উদ্বাস্তু সমস্যা— এগুলোই মূলত যুগের পর যুগ ধরে চলা বিরোধের অন্যতম কারণ। দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান অর্থাৎ ইজরায়েলের পাশাপাশি পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা নিয়ে প্যালেস্তিনীয়দের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনে হয়তো শান্তি আসতে পারত। যদিও হামাস এই দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তারা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে ইজরায়েলের বক্তব্য, পড়শি প্যালেস্তিনীয়রা যাতে তাদের সার্বভৌমত্বের জন্য আতঙ্কের না হয়ে ওঠে, তা দেখা তাদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.