বছরভর অনেক মন্দের মাঝেও ভাল কিছুকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে মানুষ। খলনায়ক অতিমারীর মধ্যে থেকেও সঞ্জীবনী জোগাড় করে নিতে চেয়েছে। যা সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে বইকী। বছর শেষে হাজার খারাপের ওপারে ভালর সন্ধান দিল সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল।
পুঁজির যেমন কোনও ভাল ভূমিকা থাকতে পারে না, লকডাউনেরও তেমনই। দুই ক্ষেত্রেই যাঁরা এমত বিশ্বাসে থিতু, তাঁদের স্থির-প্রত্যয়ী হওয়ার বিবিধ কারণ আছে। এবং, সেগুলোকে কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না। তবে কিনা, সময়ের চলমানতার মধ্যেই এমন এক ধরনের বহুবাচনিকতার আভাস থাকে যা কিছু তর্কের জন্ম দেয়। আজ তাই যখন, বছর শেষে ইতিউতি শোনা যায়,- ‘লকডাউন বলে এই পারলাম’ বা ‘শিখলাম তো এই লকডাউনে’, – তখন মাকড়সা-দৃষ্টি ছেড়ে ফিরে দেখতে ইচ্ছে হয়, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থার পাহাড় পেরলে কিছু আলোর আভাসও কি তবে ছিল! ছিল কি এমন কোনও পরিসর, যার সঙ্গে বহুদিন আমাদের মোলাকাত হয়নি, অথচ হওয়া জরুরি ছিল একান্ত।
আতঙ্কের দিন। অজানা দিন। ফলত, ভয়েরই। জানার চৌহদ্দিতে যা কিছু পড়ে না, মানুষের তা নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়, ভয় থাকে। মহামারীর কথা কত গল্পে পড়েছে মানুষ। আমরা শরৎবাবুর কাহিনিতে। কিংবা কলেরার সময় প্রেম। আমাদের অভিজ্ঞতায় কিন্তু তা ছিল না। যখন এক নতুন অসুখ মানুষের অস্তিত্বকেই পুনরায় প্রশ্নের মুখে এনে ফেলে, তখন প্রত্যাশিতভাবেই সভ্যতার সমস্ত সাজানো সৌধকে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। প্রযুক্তি, প্রগতির প্রয়োজন হঠাৎ স্তিমিত হয়ে আসে।
গোদের উপর বিষফোড়া রাষ্ট্রের অব্যবস্থা। কল্যাণকামী মুখোশ তার ধূলায় গড়াগড়ি তখন। মানুষের এই যে বেঁচে-থাকা, বসবাসের ভিতর এত স্তর, এত জটিল এই সমাজের বিন্যাস, যত দিন এগোল, তত সেই ভেদরেখাগুলো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হল। আপাতভাবে মোটা তুলির আঁচড়ে যা ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়। ফলে, একদল মানুষ যখন হেঁটে-হেঁটে ক্লান্ত, বারো বছরের জামলো যখন চৌকাঠ পেরনোর আগেই জীবন পেরিয়ে যাচ্ছে, একদল শ্রমিক যখন গা পেতে নিচ্ছে কীটনাশকের ঔদ্ধত্য, তখন আর-একদল মানুষ মন ভাল রাখতে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের যৌনতা আর হিংসায় ম্যারিনেট কনটেন্ট গিলছে গোগ্রাসে। এদিকে যখন তিনদিন পর খাবার পেয়ে চোখে জল ধরে রাখতে পারছেন না কেউ কেউ, ওদিকে তখন টিভির জনপ্রিয় রন্ধন শোয়ের সঞ্চালিকা হালকা বিরিয়ানির রেসিপি শেয়ার করে মধ্যবিত্তের গেরস্থালিকে কৃতার্থ করছেন। এই যে ব্যাপক ভিন্নতা, এর মধ্যে ভালর স্পর্শ আসলে খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার শামিল।
এই প্রবহমান জনজীবন তবু বিপর্যয়ের দিনেও কিছু সঞ্চয় তুলে রাখে কুলুঙ্গিতে। অতীতের সিন্দুক খুলে বের করেও আনে যা কিছু তার তুরুপের তাস। কেমন তা? ধরা যাক, কতদিন পর বেরোল সেই রান্নার খাতা, যেখানে রাখা আছে পূর্বরমণীদের অভিজ্ঞতা। হলদে পাতায় আজও লেগে হলুদ-জিরের গন্ধ। কিন্তু কবে যেন অ্যাপের সহজলভ্যতা আর রেস্তরাঁর মায়ামৃগ এসে আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছিল গেরস্থালির সুবাস। ফেলে দেওয়া পটলের খোসা, একটু কালোজিরে দিয়ে ফোড়ন দিলে কী চমৎকার-ই না খেতে লাগে! একটু রসুন যদি সঙ্গে দিয়ে দেওয়া যায়। এরকম কত পদ! ফেলে-ছড়ানো জীবন যাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। কিন্তু ওই সামান্যকেই অসামান্য করে তোলার কী দক্ষতাই না অর্জন করেছিলেন আমাদের মা-ঠাকুমা। আমরা জানতাম না। খেয়াল করিনি। করা যে দরকার, তা মনেও করিনি। এবার করলাম। বহু তত্ত্ব, প্রজ্ঞা পেরিয়ে এসে কত সহজে এবার বুঝলাম, প্রাচুর্যই জীবনের লক্ষ্য কিংবা মোক্ষ নয়। সুখের ঠিকানা তো নয়ই। বরং, উলটোটাই সত্যি।
প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সখ্য অনেক নিবিড় হল। যে প্রকৃতিকে দূষণের চাদরে আমরা ঢেকে ফেলেছি, যে প্রকৃতিকে আমরা শো-পিস করে বিক্রি করে দিয়েছি পর্যটনের মুনাফা আর বিনিয়োগে, সেই প্রকৃতিই যখন তার শুদ্ধ-শান্ত শ্রী ফিরে পেল, আমরা চমকে উঠলাম। কৃতকর্মে একটু লজ্জিত হলাম কি! অন্তত হওয়া তো উচিতই ছিল। সেই যখন রামায়ণ লেখা হচ্ছে, তখন মহাকবি আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন, আমাদের সঙ্গে এই অরণ্যের সম্পর্ক কতখানি অচ্ছেদ্য। আর্যপুরুষ হোন আর আদি ভূমিপুত্র, সকলেই কী সম্ভ্রমের চোখে দেখেন এই তরুরাজি, নদী, আকাশকে। আমাদের মনে পড়ে যায়, শকুন্তলার কথা। তপোবনের কথা। আমাদের স্মরণের আসে সেইসব ব্রতকথা, যেখানে গাছাগাছালি-জল আর আলাদা কিছু নয়, যেন আমাদেরই সহোদর-সহোদরা। আমরা যেন বুঝতে পারি, সিয়াটল জনজাতির সর্দারের সেই কথা। ভূমিদখলের কথা শুনে যিনি বলেছিলেন, এই প্রকৃতির উষ্ণতাকে কীভাবে বেচা-কেনা করা সম্ভব! কিন্তু এসব কথা তো না-জানা ছিল না; যা ছিল, তা হল এসবের প্রতি অঢেল উদাসীনতা। তাতেই তো নদীর জল অমন ঘোলাটে। বন্যপ্রাণীরা তাদের স্বাভাবিক চলাচলের জায়গা হারিয়েছে মানুষের ভয়ে। লকডাউন যখন মানুষকে বন্দি করে ফেলল, তখন তারা বেরিয়ে এল। যেন শুশ্রূষা ফিরে পেল আমাদের প্রকৃতি। আর আমরা খানিকটা উপলব্ধি করলাম, এই প্রকৃতি থেকে কতখানি দূরত্ব বেড়েছে আমাদের। যেন নিজেরই বসত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি আমরা। সেইহেতু এক অর্থে অনন্বয়। এই লকডাউন নিঃসন্দেহে তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
ব্যস্ততা আর বিনোদনের সাজানো বাগান আমাদের পরিবার থেকে কতখানি বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল, তা আমরা ভালোই বুঝলাম। বুঝলাম, আমাদের সম্পর্কের উপর উপর কতখানি অভ্যেসের ধুলো জমেছিল। এ-কথাও ঠিক যে, এই লকডাউনে গার্হস্থ্য হিংসা মাত্রা ছাড়িয়েছে। জীবিকাহীনতা বহু পরিবারকে নিঃস্ব করে ফেলেছে। আসলে, এই বহুস্তরীয় সমাজের এক পইঠায় আলো তো পরেরটিতেই অন্ধকার। তা পেরোতে পেরোতেই আবহমান জীবনের পথচলা। আমরা দেখলাম, ছোটোখাটো স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে পইপই করে বহুকিছু বলে যা কাজ হয়নি, এবার তা হল। আমরা নিজেদের গরজেই বেশ কিছু জিনিস মেনে চললাম। যে আয়ুর্বেদ খানিকটা কাব্যে উপেক্ষিতা হয়েই ছিল আমাদের জনজীবনে, আবার তার কাছে ফিরলাম আমরা। ছোটোখাটো ঘরোয়া জিনিস দিয়েই যে রোগ প্রতিরোধের বড়ো কজটি সেরে ফেলা যায়, এই অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় আবার খুঁজে পাওয়া গেল। বাজার নামক কোনও এক ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন আমাদের ভুলিয়ে ও ঘুলিয়ে দিয়েছিল যে এসব যেন কোনও কাজেরই নয়। অথচ এ তো আমাদের অতীতের অর্জন। যেটুকু প্রয়োজন তার, কেনই-বা গ্রহণ করব না!
আসলে, এই গ্রহণ-বর্জনের সিদ্ধান্তে থিতু হতে গেলেও যেটুকু সময় প্রয়োজন, আমাদের জীবন থেকে তা-ও চুরি হচ্ছিল। ব্যস্তসম্মত এক অলীকমানুষ হয়ে আমরা ক্রমশ ফাঁপা হচ্ছিলাম। মগজের কোষে ভিড় প্রোপাগান্ডার। ফুটন্ত জলের ব্যাঙের মতো আমরা ক্রমশ সইয়ে নিচ্ছিলাম সবকিছু। এই এতদিনে আচমকা মৃত্যুসম্ভাবানার মুখোমুখি পড়ে আমাদের ফিরে তাকানোর অবকাশ হল নিজেদের দিকে। বহুদিন পর যেন আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে বোঝালাম এই ইঁদুরদৌড়ের শেষে আর এমন কোনও পারিজাত নেই যা আমাদের কাঙ্ক্ষিত হতে পারে। এই পণ্যসংহিতায় আমাদের কোনও স্বর্গলাভ নেই। বরং যাত্রাটুকুই আমাদের প্রার্থিত। এই বেঁচে-থাকাটুকুই একমাত্র সত্যি। ফলে কেন ছুটছি, আর কে ছোটাচ্ছে- নিজের ভিতর খুঁড়ে এই সন্ধানটুকু চালানো আমাদের আবশ্যক। হয়তো চালিয়েওছি। তারপর জীবন এগিয়েছে আবার তার নিজের মতো করে। এই সমস্ত উপলব্ধি, অনুভব আর কতটা আমাদের ধরে রাখতে পারবে তা জানি না। বাজারসভ্যতার থাবা থেকে নিজেদের কতটা বাঁচিয়ে আমরা চলতে পারব, তা-ও অজানা। হয়তো সম্ভবও না। তবে, এটুকুনি সত্যি যে, সর্বার্থেই এক ঝাঁকুনি এসেছিল। যা আমাদের ভিত কাঁপিয়ে আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেছিল নয়া উপলব্ধির ভবিষ্যতে। আগামীর জন্য সেটুকুই আমাদের অর্জন।
এই অভিজ্ঞতা, এতরকমের ভিন্নতা তথ্য-পরিসংখ্যানের নিরিখেও থেকে যাবে। তা নিয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণ হবে, গবেষণা হবে, তত্ত্ববিশ্বে তা হয়তো নতুন পথ খুলে দেবে। সে বহু মণীষার কাজ। আর সেই সবকিছুর ভিতরেই জনজীবনের এই বিরাট প্রবাহ নিরুচ্চারে আগামীকে আরও একবার শিখিয়ে দেবে আত্ম-অবলোকনের বীজমন্ত্র, বেঁচে-থাকার গুপ্তবিদ্যা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.