ছবিতে ঘোষবাড়ির প্রতিমা।
সেই কবেকার কথা। আজও একইরকম ঐতিহ্য বহন করে চলেছে বনেদি বাড়ির পুজো। কত না-জানা ইতিহাস কথা বলে পুজোর দালানে। কলকাতা, শহরতলি ও জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে এমন বহু পুজো। পলাশির যুদ্ধের সময় ধানের তুষ দিয়ে খাল ভর্তি করে নবাবি সেনার সুবিধা করে দিয়েছিল যে পরিবার সেই ঘোষবাড়ির পুজোর গল্প আজ।
শুভঙ্কর বসু: কাশফুলে শ্বেত শুভ্র হাসি আর বাতাসে শিউলির গন্ধ মেখে দেবীপক্ষের সূচনা হয়ে গিয়েছে। ঘরে ঘরে আনন্দবার্তা ছড়িয়ে মর্ত্যে আগত দেবী দুর্গা। উত্তর হাওড়ার ক্ষীরোদচন্দ্র ঘোষ রোডের ঘোষ পরিবারে তাই এখন ব্যস্ততা তুঙ্গে। মা-কে বরণ করে নেওয়ার পালা। তাই যেন দম ফেলার সময় নেই বাড়ির সদস্যদের।
২১৯ বছর আগে জমিদার মাধবচন্দ্র ঘোষের হাত ধরে এই বাড়ির পুজোর সূচনা। দুই শতাব্দীর বেশি সময় পেরিয়ে আজও একই উদ্দীপনায় উমার আরাধনায় ব্রতী হন ঘোষেরা। এক সময় পুজো দেখতে এ বাড়িতে এসেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। সেই পুজোর জৌলুস আজও একই রকমভাবে বজায় রয়েছে। ১৮০১ সালে ১ নম্বর ক্ষীরোদচন্দ্র ঘোষ রোডের এই বাড়িতে পুজো শুরু করেছিলেন মাধবচন্দ্র। তখন মাধবচন্দ্রের বয়স ১৬ বছর। সেই বয়সেই পুজো শুরু করেন। মেদিনীপুরের কাকদাড়ি গ্রামে রাজ পরিবারে জন্ম হয়েছিল মাধবচন্দ্র ঘোষের। যে রাজ পরিবারকে ‘রাজাপলমল’ উপাধি দিয়েছিলেন স্বয়ং সিরাজদৌল্লা। মাধবচন্দ্রদের পরিবার ছিল সিরাজপন্থী। ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় সিরাজের পক্ষ নিয়েছিল পরিবার। রাজ পরিবারের যেমন ছিল ধনসম্পদ তেমনি প্রতিপত্তি। শোনা যায় পলাশির যুদ্ধের সময় ধানের তুষ দিয়ে আস্ত একটি খাল ভর্তি করে দিয়েছিল রাজ পরিবার। ফলে যাতায়াতের সুবিধা হয়েছিল নবাবি সেনার।
এহেন পরিবারের সদস্য মাধবচন্দ্র মাত্র ছ’বছর বয়সে মায়ের হাত ধরে হাওড়ায় আসেন। সাবালক হওয়ার আগেই জমিদারির গোড়াপত্তন করেন মাধবচন্দ্র। তার হাত ধরেই পুজোর শুরু। দুর্গাপুজো শুরুর পর মাধবচন্দ্র ঘোষের ছেলে ক্ষীরোদচন্দ্র ঘোষ ওই বাড়িতে রাধামাধবের নিত্যপুজো শুরু করেন। সেই নিত্য পুজোর আসনেই পূজিতা হন দেবী দুর্গা। এক চালার লোহার সিংহাসনে পুজো হয়। যেটির চালচিত্র বৈষ্ণব পুরাণ ও চণ্ডী পুরাণ। এই বাড়ির দুর্গার রূপ যেন জীবন্ত মূর্তি। দেবীর প্রত্যেকটি অস্ত্র সোনার। আরেকটি বিশেষত্ব হল পুজোর এক সপ্তাহ আগে থেকে চণ্ডীপাঠ ও গীতা পাঠ শুরু হয়। ষষ্ঠীর দিন নাট মন্দিরে বেল বরণ হয়। সপ্তমীর দিন কলা বউ স্নান করিয়ে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে বলিদান ও চক্ষুদান হয়। চালকুমড়ো বলি দিয়ে দান অর্পন করা হয়। অষ্টমী পুজোর শেষে নবমী পুজোর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপুজো হয়।
নবমীর দিন হল ঘোষবাড়ির পুজোর আলাদা আকর্ষণ। এদিন এক বিরল রীতি দেখা যায়। সম্ভবত আর কোথাও পুজোয় এমন রীতি দেখা যায় না। রীতি অনুযায়ী বাড়িতে বউকে দেবী রূপে কল্পনা করা হয়। বউয়ের হাতে ও মাথায় ধুনুচি রেখে তাতে ধুনো পোড়ানো হয়। পুজোর শুরু থেকে এখনও এই রীতি চালু রয়েছে। এমনটাই জানাচ্ছিলেন পরিবারের এ প্রজন্মের সদস্য শুভজিৎ ঘোষ। তাঁর কথায়, মাধবচন্দ্র ঘোষই নাকি এমন রীতি চালুর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। সেই থেকে আজও সমান গুরুত্ব দিয়ে এই বিরল প্রথাটি চালু রেখেছি আমরা।” এছাড়া নবমীর দিন একইভাবে কুমারী পুজো হয়ে আসছে ঘোষেদের বাড়িতে। অনেকে মনে করেন যে, দুর্গাপুজোয় কুমারীপুজো সংযুক্ত হয়েছে তান্ত্রিক সাধনামতে।
ব্যাখ্যা যাই হোক, যথাসম্ভব আভিজাত্যে আজও দেবী কল্পনা করে বাড়ির বউয়ের আরাধনা ও কুমারী পুজো হয়ে আসছে ঘোষ পরিবারে। মাধবচন্দ্র ঘোষ ও তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের পুজো উদ্যোক্তাদের আমলে পুজোর চারদিন বাউল গান, কবিগান ও যাত্রার আসর ছিল মাস্ট। তাছাড়া থাকত ঢালাও ভোগ খাওয়ানোর চল। এসবই আবার নতুন করে তুলে ধরতে চাইছে ঘোষেরা। বর্তমানে পরিবারের চার সদস্যের হাতে পুজোর দায়িত্ব। শুভজিৎবাবু আরও বলেন, “এক সময় দুর্গাপুজোতে বাউল গান, কবি গানের জমাটি আসর হত। এবছর তেমনই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এবছর অনুষ্ঠান করতে আসছেন ইসকনের ভক্তবৃন্দ। এছাড়াও ভরত নাট্যম ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকছে। নবমীর দিন পুর্ব মেদিনীপুরের লোক সংগীত বাউল অনুষ্ঠিত হবে।”
[হুগলির হরিপালে দ্বারিকাচণ্ডী রূপে পুজিতা হন দেবী দুর্গা]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.