উর্মি খাসনবিশ:
-“মা ঠাকুরের পিছন দিকটা রং নেই কেন?”
-“ওটাতো কাঠামো বাবান। ওইদিকটা দেখা যায় না যে। তাই রং করার দরকার পরে না।”
সাড়ে চার বছরের শিশুটি তখন ভাবছে কাঠামো কী বস্তু? দেবী প্রতিমার অঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঠিকই তবে আদর নেই বিন্দুমাত্র। কেউ মা দুর্গার চোখের তারিফ যেমন করে করছেন, তাঁর কাঠামোর তারিফ তেমনভাবে করছে না। এমনকি সামান্য রংও দেওয়ার ব্যবস্থা হয়নি। এতটাই ব্রাত্য। যেমন চুপিসারে পুজোর চারদিন আলোর পিছনে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলে, তেমন চুপচাপই বিসর্জন যাবে। যেন এটাই দস্তুর।
আসলে যে কোনও কর্মযজ্ঞে যাঁরা সবচেয়ে বেশি সামিল হন, একেবারে বেস লেভেলের কাজ করেন, তাঁদের খোঁজ বিশেষ রাখেনি ইতিহাস। ঐতিহাসিক যুদ্ধগুলির ক্ষেত্রেও মানুষ মনে রেখেছেন তাবড় রাজা-মহারাজাদের নাম। আর বোড়েরা? তাঁরাও সেই খানিক কাঠামোর মতো। কেবলই কাঠামো। কোনও নাম নেই।
পুজোর আর বিশেষ বাকি নেই। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। চতুর্দিকে ব্যস্ততা। আমার আপনার মতো মানুষের কাছে পুজোর চারদিন মানে যেখানে শপিং, প্যান্ডেল হপিং, সেলফি, জমিয়ে সাজগোজ আর দেদার খাওয়া-দাওয়া, সেখানে অপর একদল মানুষের কাছে পুজো মানে কয়েকটা টাকার বদলে আমাদের সারা বছরের অপেক্ষাকে সার্থক করা। যার জন্য তাঁদের কেউ হয়তো বাড়ি ছেড়েছেন পুজোর দু’মাস আগে, কেউ আবার সাতদিন, কেউ আবার পুজোর দিনগুলিতেই থাকবেন না বাড়িতে। আর কেউ পুজোর দিনগুলোতে বাড়তি কয়েকটা টাকার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করবেন, যাতে তাঁদের বাড়ির লোকগুলোও ওই চারটে দিন কাটাতে পারে একটু অন্যভাবে। আনন্দে।
পুজো নিয়ে কত লেখালিখিই তো হচ্ছে। মণ্ডপসজ্জা, আলোকসজ্জা, প্রতিমা, শিল্পী, পুজোর ফ্যাশন, খাওয়াদাওয়া বাদ যাচ্ছে না প্রায় কিছুই। তাই ভাবলাম আনন্দোৎসবের এই বিরাট কর্মযজ্ঞে একটু বোড়েদের গল্প বলি।
সেদিন রাত তখন ৯ টা, যখন পুজো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে বাবুবাগান পুজো প্রাঙ্গনে প্রবেশ করলাম। বোড়েদের গল্প লিখতে চাই বলায় প্রথমটায় শিল্পীর সঙ্গে তাঁরা আমায় আলাপ করিয়ে দিতে চাইলেন সেখানকার উদ্যোক্তারা। তারপর যখন নিজেই যাঁরা মিস্ত্রির বেশে কাজ করছেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলার উদ্যোগ নিলাম, তাঁরা ব্যাপারটা বুঝে আমায় আলাপ করিয়ে দিলেন সঞ্জিত সরকারের সঙ্গে।
প্যান্ডেলের পিছন দিকটায় মাচা বেঁধে থাকছেন ডেকরেটর কর্মীরা। সবুজ যে কার্পেটগুলো প্যান্ডেলে বিছানো থাকে, সেই কার্পেট দিয়েই ঢাকা দেওয়া মাচাটা। জিজ্ঞাসা করলাম কতদিন ধরে রয়েছেন এখানে? “আগস্ট মাসের ২৬ তারিখ থেকে এখানে রয়েছি। এর আগে অন্যান্য প্যান্ডেলেও কাজ করেছি। মোট ৬ টা।” এত্তদিন বাড়িছাড়া? প্রশ্নের উত্তরে লাজুক হেসে সঞ্জিত বাবু বললেন, “মাসে একবার করে বাড়ি যাই আমরা দিদি। আমি তো আগামীকাল যাব। বাড়িতে দু’টো ছেলে আছে। বাবা, মা, বউ আছে। ওদের পুজোয় জামাকাপড় কিনে দেব।” নিজের জন্য কিছু কিনবেন না? প্রশ্নটা করতেই বললেন, “টাকা যদি বাঁচে তবেই। নইলে নয়।”
কথায় কথায় প্রশ্ন করলাম, “পুজোর সময় পরিবার নিয়ে কলকাতায় বেড়াতে আসেন?” বললেন, “হ্যাঁ। পরিবারের লোকজনের জন্যই আসি। ছেলেদুটো কলকাতার পুজো দেখতে ভালবাসে খুব। আর যেই পুজোগুলোতে কাজ করি সেখান থেকে ভিআইপি পাস নিয়ে নিই। কয়েকটা পুজো ওদের ভিড় এড়িয়ে দেখাতে পারি।”
এতদিন ধরে কাজ করছেন এখানে, এভাবে রয়েছেন, সমস্যা হয়না? প্রশ্নের উত্তরে সঞ্জিত বাবু বললেন, “আমরা সবাই এখানে হয়তো কষ্ট করেই রয়েছি। তবে কাজটা খুব ভালবেসে করি। সবাই আমরা একসঙ্গে আনন্দ করে কাজ করি।”
রাজ্যবাসীর চারদিনের আনন্দের জন্য কতটা পরিশ্রম রয়েছে তাঁর খানিক আঁচ পেলাম এই পুজোয়। দুর্গাপুজোর এই কাঠামোদের খোঁজ জারি থাকবে। সেই সঙ্গে পুজোর সময় কোনও প্যান্ডেলের ভিড়ে খুঁজে নিতে চেষ্টা করব সঞ্জিত বাবুর মতো মানুষদের। যাঁরা পুজো প্রস্তুতির প্রাথমিক কারিগর হয়েও রয়েছেন ভিড়ের মধ্যেই মিশে। নিজের বাঁধা বাঁশ বা প্যান্ডেলের গায়ে তুলি দিয়ে আঁকা ছবিটাকে দূর থেকে দেখছেন। আর প্যান্ডেলটাকে অপত্য স্নেহে ভালবাসছেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.