শুভময় মণ্ডল: দীর্ঘ কয়েকমাসের পরিশ্রম৷ হাড়-ভাঙা খাঁটুনি৷ তিলে তিলে গড়ে তোলা কাজ৷ এ সবই মাত্র কয়েকদিনের জন্য৷ সেই দিনগুলির হই-হুল্লোড়, মজা, আনন্দ৷ তারপরই ঘনিয়ে আসে বিদায়বেলার ক্ষণ৷ যাঁর জন্য এত প্রস্তুতি সেই উমার বাড়ি ফেরার পালা৷ অস্রুজলে মাকে বিদায় জানানোর পর বিষাদে কটাদিন কাটায় আপামর বাঙালি৷ যেতে দিতে চায় না মন৷
কিন্তু শহরের এত পুজো, এত জাকজমক, এত আয়োজন তখন সবই খাঁ খাঁ অবস্থা৷ শহরের থিমের পুজোর ফ্যান্টাসিও তখন শেষ হয়ে যায়৷ থিমশিল্পীদের তিলে তিলে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গড়ে তোলা শিল্পকর্মর মূল্যও কিছু থাকে না বললেই চলে৷ কথায় আছে না, যতদিন না লাগে গড়তে তার চেয়েও কম সময় লাগে ভাঙতে৷ তাই পুজো শেষ হতেই শুরু হয়ে যায় ভাঙার পালা৷ নিজের ভাবনা-পরিকল্পনায়, দু’হাতে গড়ে তোলা সৃষ্টিকে চোখের সামনে ভাঙতে দেখলে কারই বা মন ভাল থাকে৷ তাই শহরের বহু শিল্পীই পুজো শেষ হতেই এমন দৃশ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন৷ দুঃখ ভোলাতে এই সময়টা তাই অনেকেই নিজের জন্য সময় কাটান৷ কেউ গ্রামের বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান, কেউ আবার এবছরের ভুল-ত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী বছরের জন্য নতুন উদ্যমে প্রস্তুতি নেন৷ কারও কাছে এই বিষাদ সাময়িক মাত্র, বিসর্জনের বাস্তবতাকে তিনি মেনে নেন৷
সত্যি কথা বলতে শিল্পীদের এখন অঢেল সময় হাতে৷ সেই কয়েকমাসের দৌড়-ঝাঁপ এখন সময়ের আলমারিতে তুলে রেখে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন অনেকে৷ প্রতি বছরের মতো এবারও পুজোর কটাদিন বর্ধমানে গ্রামের বাড়িতে সময় কাটিয়েছেন শিল্পী পূর্ণেন্দু দে৷ তাঁর সৃজনে কি কামালটাই না দেখিয়েছে দক্ষিণ কলকাতার ৬৬ পল্লি আর আহিরীটোলা সার্বজনীনের পুজো৷ রেখায় রেখায় তিলোত্তমা এবং শিল্পীর সাধনভূমি ফুটিয়ে তুলে পুজোপ্রেমীদের মন জয় করে নিয়েছেন তিনি৷ তাঁর মতে, “শিল্পীর কাজ তাঁর সন্তানের মতো৷ সেই অপত্যস্নেহ বশতই নিজের কাজ ভেঙে ফেলার দৃশ্য চোখে দেখা যায় না৷ বিসর্জনের সময়ও তাই আর মন ভাল থাকে না৷ তাই পুজোর আগে চুটিয়ে কাজ করে সপ্তমী থেকেই গ্রামের বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে ময় কাটাই৷ মনের কোণে চাপা দুঃখ ভোলানোর চেষ্টা করি৷” একইরকমভাবে বিসর্জনের বিষাদ সইতে পারেন না শিল্পী গোপাল পোদ্দার৷ তাঁর সৃজনে হাতিবাগান নবীন পল্লিতে কাবার্ড তথা চলমান দেবালয় এক অনন্য মাত্রা এনে দিয়েছে শহরের থিম পুজোয়৷ রাজস্থানের বাসি জেলার সেই কাঠের পাল্লাওয়ালা আলমারিতে আঁকা পৌরাণিক উপাখ্যান এখন সবার মুখে মুখে ফিরছে৷ সেই কাজ ফুটিয়ে তুলতে বহুদিন লেগেছে শিল্পীর৷ রাজস্থান থেকে সেই শিল্পীদের এনে কাজ করানো কি কম ঝক্কির৷ কিন্তু এত দুর্মূল্য জিনিসের সমাহার, যার পিছনে এত পরিশ্রম পলকে সেগুলি খুলে নেওয়াটা মন থেকে মেনে নিতে পারেন না শিল্পী৷ তাঁর মতে, “মন ভাল করতেই দশমীর দিনই পালিয়ে এসেছি বোলপুরে৷ এখানে আমার নিজের কর্মশালা নিয়েই ব্যস্ত থাকব কিছুদিন৷ অবসাদও কমবে৷ কিন্তু এত পরিশ্রমের কাজ যদি সংরক্ষণ করা যেত তাহলে বেশ ভাল হত৷”
বিসর্জনের বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ারই পরামর্শ দেন শিল্পী বিশ্বনাথ দে৷ তাঁর সৃজনে এবার অক্ষরে অক্ষরে মায়ের নাম মিলেছে বেহালা ফ্রেন্ডসের পুজোয়৷ প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি৷ কাঠের উপর খোদাই করা অক্ষরে অক্ষরে মায়ের ভিন্ন ভিন্ন নামই ছিল তাঁর থিমের বিষয়৷ বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছে এই পুজো৷ বিসর্জনের জন্য আক্ষেপের সুর তাঁর গলাতেও৷ তবে একে কঠিন বাস্তব ভেবেই এগিয়ে যেতে চান তিনি৷ তাঁর ভাষায়, “বোধন হলে বিসর্জন তো হবেই৷ এটাই রূঢ় সত্য৷ তবে এ বিষাদ সাময়িক৷ মন খারাপ করলেও তো কিছু করার নেই৷ সৌজন্যতার খাতিরেই বিসর্জনে থাকতে হয়, কিন্তু মন মানতে চায় না৷” শহরের মহিলা থিমশিল্পীদের অন্যতম অদিতি চক্রবর্তী৷ বাড়িতে রয়েছে ‘স্পেশ্যাল চাইল্ড’৷ তাকে সামলে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া৷ তাই পুজোর কটাদিন দম ফেলার ফুরসত পান না তিনি৷ তাঁর সৃজনে এবার সন্তোষপুর লেকপল্লি ও হরিদেবপুর বিবেকানন্দ পার্ক অ্যাথলেটিক ক্লাবের পুজো সেজে উঠেছিল৷ লেকপল্লিতে সোনার দুর্গা ও বিবেকানন্দ পার্কে ঠাকুরমার ঝুলি বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে৷ তবুও এবার তাঁর মনে কিছু খচখচানি রয়ে গিয়েছে৷ ভাল কাজ করেও কোথাও যেন একটা আক্ষেপ রয়ে গিয়েছে তাঁর৷ তাই এবছরের ভুল-ত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী বছরের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি৷ “পরের বছর কাজ করতে অনেক সাহায্য করবে এবছরের শিক্ষা৷ যে ভুল-ত্রুটি রয়ে গেল তা পরের বছর যাতে নাহয় সেদিকে খেয়াল রাখব৷ আর নিজের সৃষ্টিকে ধ্বংস হতে দেখে কার ভাল লাগে? তাই এইসময়টা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি৷ মন ভাল রাখার চেষ্টা করি৷”
পুজো আসে পুজো যায়৷ বাঙালির পুজোর ফ্যান্টাসি একই রয়ে যায়৷ আর এবছরের ভুল-ত্রুটির মধ্যে আগামী বছরের জন্য নতুন ভাবনার রসদ খুঁজে পান শিল্পীরা৷ বিসর্জনের বিষাদেও আগামীর পথ চলার আনন্দ খোঁজেন তাঁরা৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.