সৈকত মাইতি, তমলুক: দুই পা পলিও আক্রান্ত হওয়ায় নিজেই ঠিক মতো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারেন না। কিন্তু তা সত্বেও প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় ট্রাই সাইকেল নিয়েই জেলায় দাপিয়ে বেড়ান চণ্ডীপুরের বছর ৬৩-এর চাওয়ালা। সকলের কাছে তিনি রবীনদা নামেই পরিচিত। এই বৃদ্ধ মানুষটির জেদ আর ভরসাই এখন সাহস যোগাচ্ছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের অসহায় প্রতিবন্ধী পরিবারের মানুষজনদের।
[সম্প্রীতির নজির, মুসলিম মায়ের কবরে মাটি দিলেন প্রতিবেশী হিন্দু ছেলে]
রবীন্দ্রনাথ সংগ্রাম। চণ্ডীপুরের সরিফুর এলাকার বাসিন্দা। তিন ভাইদের মধ্যে মেজ ছেলে রবীন্দ্রনাথবাবু। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের মধ্যেই জন্মের পর থেকে তিনি আর পাঁচজনের মতই স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে উঠেছিলেন। কিন্তু মাত্র তিন বছর বয়সেই পোলিওয় আক্রান্ত হওয়ার পরই তাঁর জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। ছয় মাস টানা টাইফয়েডে ভুগে বিছানায় শুয়ে থেকেই দুটি পা বিকল হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে হাঁটা চলার শক্তি হারান রবীনবাবু। কাজেই বাড়ির কাছে স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষার পরই তার পড়াশোনা হয়ে উঠেনি। অষ্টম শ্রেণিতেই পড়াশোনায় ইতি টেনে প্রতিবন্ধী অবস্থাতেই তিনি চণ্ডীপুরে জাতীয় সড়কের পাশে একটি চায়ের দোকান খুলে বসেন। তার থেকে যা উপার্জন হত, তা দিয়েই তিনি ছুটে যেতেন জেলার বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রতিবন্ধী পরিবারের পাশে।
প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন সরঞ্জাম তুলে দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষার বিষয়েও সচেতন করতেন। প্রতিবন্ধীদের সরকারি সাহায্যে ব্যাংক ঋণ নিয়ে স্বনির্ভর হওয়া থেকে শুরু করে অক্ষম ভাতা পাওয়া, বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সরকারি সুযোগ সুবিধা জানানো, উপযুক্ত চিকিৎসা, পড়াশোনো, শরীর চর্চা সব ক্ষেত্রেই শুধু উপদেশ বা পরামর্শই নয়। রীতিমতো পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। নিজে অবিবাহিত থেকেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সামাজিক কর্তব্যবোধ থেকে ইতিমধ্যেই নিজের উদ্যোগেই তিনি পিছিয়ে পড়া প্রতিবন্ধী যুবক যুবতীদের সাতজোড়া বিয়েরও আয়োজন করেছেন। প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে নেমে ২০০৬ সালে তমলুক থেকে কলকাতার যাদবপুর, এরপর ২০১৪ সালে কোলাঘাট থেকে দিঘা পর্যন্ত ট্রাই সাইকেল র্যালিতে অংশ নিয়েছেন।
[মোবাইল নিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষক, ফের বিতর্কে ময়নাগুড়ির স্কুল]
প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে বিভিন্ন আইনের বই তিনি নিয়মিতভাবে চর্চা করেন। আর কোথাও প্রতিবন্ধীরা কোনও সমস্যায় পড়লে তিনি ছুটে যান। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতার পাঠ দেন। তিনি প্রতিবন্ধী নারী পুরুষদের পাশে দাঁড়ান। আর তাঁর এই একক কৃতীত্ব দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে নিমতৌড়ি তমলুক উন্নয়ণ সমিতিও। স্বীকৃতি হিসাবে তিনি এখন পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন ও অধিকার রক্ষা সমিতির সহ-সম্পাদক পদে রয়েছেন। এছাড়াও ২০১৬ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে রাজ্য সরকার তাঁকে রোল মডেল হিসাবে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছে।
তবে সর্বদাই নিশ্বব্দে এমন অসহায়দের ত্রাতা হিসাবে কাজ করে যাওয়া বৃদ্ধ মানুষটি অবশ্য তার এই কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তেমন কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। রবীনবাবু বলেন, “আগামী প্রজন্মের প্রতিবন্ধীরা যাতে তাদের সমস্ত রকমের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় তার জন্যই এই প্রয়াস।” নিমতৌড়ি তমলুক উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক যোগেশ সামন্ত বলেন, “রবীনবাবুর কার্যকলাপে সত্যিই জেলার বহু প্রতিবন্ধীই উপকৃত। তাঁর প্রেরণায় জেলার প্রায় ১লক্ষ ২৩ হাজার প্রতিবন্ধী পরিবারের মুখে হাসি ফুটেছে।” নিজে প্রতিবন্ধী হলেও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে তার যথেষ্টই অবদান রয়েছে।
ছবি : রঞ্জন মাইতি
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.