সরোজ দরবার: ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর জানার কথা নয় ‘দ্বাদশ ব্যক্তি’ নামে একটি অসাধারণ উপন্যাস লিখেছিলেন বাঙালি সাহিত্যিক মতি নন্দী৷ তাঁর এও জানার কথা নয় ইউরোর ফাইনালে পায়েতের ট্যাকল যেদিন তাঁকে মাঠের নায়ক থেকে মাঠের বাইরের দ্বাদশ ব্যক্তি করে দেবে সেদিনটাই ছিল মতি নন্দীর জন্মদিন (১০ জুলাই)৷ ইতিহাসের কী আশ্চর্য সমাপতন! কলমের জোরে দ্বাদশ ব্যক্তির কথা লিখেছিলেন যিনি, তাঁর জন্মদিনেই নিজের ক্যারিশমায় দ্বাদশ ব্যক্তিকে নিয়ে আর এক রূপকথা রচনা করলেন খোদ রোনাল্ডোই৷
ইউরো ফাইনালে মাঠে ছিলেন সাকুল্যে ২৪ কি ২৫ মিনিট৷ তাও চোটের জন্য বার দু’য়েক বাইরে এসেছেন৷ অথচ ইউরোতে ৪১ বছর পর পর্তুগালের শাপমোচনের ইতিহাসে তিনিই নায়ক৷ কেন? শুধুই ফুটবল! নাকি ফুটবল ছাপিয়েও আরও অনেক কিছু? মাঠে না থেকেও কী করে সাফল্যের কাহিনীর মধ্যমণি হয়ে উঠতে হয়, গোটা বিশ্বকেই তা আক্ষরিক অর্থে যেন শিখিয়ে দিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো৷
তিনি একরোখা৷ তিনি জেদি, উদ্ধত৷ তাঁর জীবনযাপন অনিয়ন্ত্রিত৷ বিভিন্ন সময় বান্ধবীদের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা মুখরোচক গল্পের জন্ম দিয়েছে৷ তাঁর ফ্রি-কিক বা ড্রিবলের বৈচিত্র নিয়ে যত নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়, তাঁর স্টাইল স্টেটমেন্ট নিয়ে তা থেকে কিছু কম কাগজ খরচ হয় না৷ তিনি এরকমই৷ ঝোড়ো হাওয়ার মতো৷ আসলে বিশ্বজোড়া ফুটবলপ্রেমীরা জানেন, যত সমালোচনা হোক না কেন, যতই অনিয়ন্ত্রিত হোক না কেন তাঁর জীবনযাপন, বক্সের মধ্যে তাঁর পায়ে বল গেলে বিপক্ষের জাল ছোঁয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা দাঁড়ায়৷ এহেন রোনাল্ডোকেই যখন চোট পেয়ে ইউরো ফাইনালের মতো বড় আসর ছেড়ে চলে আসতে হয়, তখন প্রকৃত ফুটবলপ্রেমী মাত্রই যে বিষণ্ণ হবেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই! তিনি নিজেও তো কেঁদেছেন৷ কেঁদেছে তাঁর অগণিত ফ্যান৷ কিন্তু দুঃখের অশ্রুকে কী করে আনন্দাশ্রুতে পরিণত করতে হয় তা জানেন বলেই দ্বাদশ ব্যক্তির এই রূপকথায় নায়ক রোনাল্ডোই৷
মাঠের বাইরে গিয়ে কী করলেন রোনাল্ডো? মাঠের ভিতরে থেকে তাঁর স্কিল দিয়ে যে উৎসাহ চারিয়ে দিতেন সতীর্থদের মধ্যে, সেটাই করলেন বাইরে থেকে৷ তাঁর রাগ, জেদ, অভিমানে, তার না খেলতে না-পারার বেদনায় যেন গোটা পর্তুগাল দল তেতে ওঠে তার জন্য চেষ্টার কসুর করলেন না৷ তিনি জানতেন, মাঠে তাঁকে দেখে দুটো উইং থেকে তাঁর দিকে যেমন বল ভাসিয়ে দেন সতীর্থরা, ঠিক তেমনই সাইডলাইনের ধারে তাঁকে দেখে বিপক্ষের জালে বল ঢোকানোর বাড়তি তাগিদ পাবেন তাঁরা৷ তাই বসে থাকেননি৷ উঠে এলেন৷ বিরতিতে কোনও সতীর্থকে ম্যাসাজ দিলেন৷ কারও মাথা ঝাঁকিয়ে দিলেন৷ খেলা শুরু হওয়ার পর থেকে সাইডলাইনের ধারে তাঁর চাবুকের মতো শরীরটা ক্ষিপ্র গতিতে এদিক ওদিক করতে লাগল৷ গোটা বিশ্ব দেখল, কীভাবে না খেলেও খেলাটাকে নিজেদের দিকে টেনে আনা যায়৷ যে এডের বড় কোনও প্রতিযোগিতাতে গোল করা দূরে থাক, খেলারই সুযোগ পান না, তাঁর গড়ানো শট যখন ফ্রান্স গোলরক্ষক লরিসকে শুইয়ে দিয়ে ফ্রান্সের স্বপ্নভঙ্গ করে জালে জড়ায়, তখন বিশ্বের বুঝতে বাকি থাকে না, কোথা থেকে এই চালিকাশক্তিটি পেয়েছেন তিনি৷
শুধু তো পর্তুগাল দলটির নিরিখে নয়, বিশ্ব ফুটবলের নিরিখেও অনেক কিছু প্রমাণের ছিল৷ রিয়াল, বার্সেলোনার চির প্রতিদ্বন্দ্বিতার জেরেই রোনাল্ডো বনাম মেসি এক বহুলচর্চিত বিষয়৷ ক’টাদিন আগেই কোপায় নিজের খেলায় হতাশ হয়ে, দেশকে ট্রফি এনে দিতে না পেরে দেশের জার্সি নামিয়ে রেখেছেন মেসি৷ গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো মাথার উপর ঝুলছে কর অনাদায়ে কারাদণ্ডের সাজা৷ মুখে মেসিকে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছেন, কিন্তু ছায়াযুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বীকে এরকম দাঁড় করিয়ে গোল দেওয়ার সুযোগ রোনাল্ডো কি হাতছাড়া করবেন! করার তো কথা নয়৷ বুক চিতিয়ে তাই বলেছিলেন, ইউরো পর্তুগালই পাচ্ছে৷ কিন্তু আচমকা চোট যেন সেই সবকিছুতে থাবা বসিয়ে দিয়েছিল৷ সারা বিশ্ব উৎকণ্ঠায় ভেবেছিল তবে কি কোপার মতো আবারও এক ট্রাজিক নায়কের ইতিহাস রচনা হবে ইউরোর ফাইনালে! কিন্তু তিনি ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো৷ তিনি জানেন হেরে যাওয়ার জন্য বিশ্বে অনেকে থাকতে পারেন, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে কর্ণের নিয়তি তিনি মেনে নেবেন না৷ রথের চাকা যদি বসেও যায়, তিনি ঠিক তা টেনে তুলবেনই৷ ফলত মেসি যা পারলেন না, তিনি তা পারলেন৷ খেলতে পারলেন না ঠিকই, তাঁর শিল্পিত ফুটবল থেকে বঞ্চিত হল বিশ্ব, কিন্তু একাধারে কোচ, বন্ধু, টিম ম্যানেজার, অলিখিত অধিনায়ক হয়ে দেশকে ট্রফি দিতে পারলেন৷ বলে পা ছোঁয়াতে না পেরে ১০০ মিনিট আগে যিনি হতাশায় মাঠে শুয়ে পড়েছিলেন, তিনিই ট্রফির দিকে তাকিয়ে আনন্দে সেই মাঠেই শুয়ে পড়লেন৷ আগের দৃশ্যে যাঁরা চোখের জল মুছেছিলেন, এই অভূতপূর্ব উত্থানের রূপকথা দেখে তাঁরা হাততালি দিলেন৷ আসলে সে হাততালি যেন আবহমানের এক স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের জন্য৷ টিম গেম ফুটবল তো আজও আবর্তিত হয় এক একটি নামকে কেন্দ্র করে৷ তিনি নিজেও সেরকম একটি নাম৷ অথচ নাম ছাপিয়েও যে বড় হয়ে উঠতে পারে ফুটবল, তা প্রমাণ করে দিলেন রোনাল্ডোই৷ যে ঔদ্ধত্যের, যে একরোখামির জন্য তিনি সমালোচিত হন, তাই-ই এদিন পর্তুগালকে পৌঁছে দিল জয়ের সরণিতে৷ আর রোনাল্ডো প্রমাণ করে দিলেন সাহিত্যের পাতা হোক বা সত্যিকারের ময়দান, যে হার মানে না সেই নায়ক৷ সে প্রথম ব্যক্তি হোক বা দ্বাদশ ব্যক্তি, তা আদৌ ম্যাটারই করে না৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.