টিটুন মল্লিক, বাঁকুড়া: একতলা বাড়ির চারপাশ ঝোপঝাড়ে ভরতি। জানালা প্লাস্টিকের ছেঁড়া ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। দেওয়াল শ্যাওলা জমেছে। দরজা খুলে দুই বোন লিলি আর টুকটুকি দেখালেন তাঁদের দিদি অর্চনা কোথায় শুয়ে থাকতেন। সেই জায়গা তখনও এলোমেলো। নোংরা মশারি দুখুঁট খোলা অবস্থায় ঝুলছে। অপরিচ্ছন্ন ঘরে ডুকলেই যেন অস্বস্তি হবে। গত কয়েক দিন ধরে বাঁকুড়ার প্রতাপবাগান গোবিন্দপ্রসাদ বিথি লেনের দিদির মৃতদেহ এভাবে আগলে রেখেছিলেন তিন বোন।
[লালগড়ের জঙ্গলে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার! বন দপ্তরের ক্যামেরায় অবিশ্বাস্য ছবি]
বাড়ি থেকে মৃতদেহ পচার কটূ গন্ধ বেরোতে স্থানীয় বাসিন্দাদের সন্দেহ হয়। এদিনও ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় পরিস্থিতি একইরকম। মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই সামনের একচিলতে ঘর ও একফালি বারান্দা। ঘরের একপাশে দুটি পাত্রে শুকনো মুড়ি রাখা। একদিকে মেঝেতে পড়ে কাগজ কাটার ছুরি, ভিতরে ঘরে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ওষুধের খাম এবং নথিপত্র। রান্নাঘরের অবস্থা তথৈবচ। উনুনে একটি ফাঁকা স্টিলের হাঁড়ি ও বাটি বসানো। বাটিতে অল্প জল রাখা। গত বৃহস্পতিবার বসন্ত উৎসবের দিন বাঁকুড়া সদর থানার পুলিশের কাছে এবিষয়ে খবর আসে। মৃতের নাম অর্চনা পাল (৬০)। বাঁকুড়া সদর থানার পুলিশ মৃতদেহ বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায়। ওই বাড়িতে দেহের সঙ্গে ছিলেন তিন বোন তপতী, লিলি আর টুকটুকি পাল। তপতীদেবীর পা ভেঙে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভরতি। লিলি আর টুকটুকিকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় সূত্রে খবর তপতী দেবী স্থানীয় পূর্ত দপ্তরে আপার ডিভিশন ক্লার্কের কাজ করেন। তার টাকাতেই সংসার চলে। বাঁকুড়ার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রতাপবাগানের ওই বাড়ির মালিক ছিলেন ভজহরি পাল। তাঁর পাঁচ মেয়ে হল অর্চনা, তপতী, জয়ন্তী, লিলি এবং টুকটুকি। স্থানীয়রা বলছেন জন্মের পর থেকেই পাঁচ বোন মানসিক রোগে আক্রান্ত। বাবা ভজহরি পাল মারা গিয়েছেন বহু বছর আগে। বছর কয়েক আগে ভজহরিবাবুর স্ত্রী এবং এক মেয়ে জয়ন্তীর মৃত্যু হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, বছর দুয়েক আগে মায়ের মৃত্যুর পরও তাঁর মৃতদেহ তিনদিন এই ঘরে পড়েছিল। পরে পাড়ার বাসিন্দাদের উদ্যোগেই মৃতদেহ সৎকার করা হয়েছিল।
[দামি মোবাইল ছিনতাইয়ে বাধা, চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলা দেওয়া হল যাত্রীকে]
প্রসঙ্গত, গত ২০১৫ সালের ৩ জুন রবিনসন স্ট্রিটের বাড়িতে এমন অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে দিদি দেবযানীর কঙ্কাল আগলে বসে থাকতে দেখা যায় ভাই পার্থ দেকে। গত কয়েকদিন মৃত দিদির কথা কাউকে বলেননি কেন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন তপতী, লিলি ও টুকটুকি? এ প্রশ্নের কোনও উত্তর মেলেনি তাদের কাছে। পড়শিদের দাবি অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা এই পাল পরিবারের অবিবাহিত চার মহিলা এলাকায় কারও সঙ্গে মেলামেশা করেন না। অপরিচ্ছন্নভাবে থাকেন। মায়ের মৃত্যুর পর এই চার বোনকে বিশেষ দেখতেও পাওয়া যায়নি। ওই বাড়ি থেকে অল্পবিস্তর কটূ গন্ধ পেয়েছেন কেউ কেউ। প্রতিবেশী অশোক কুমার শিট আর মনোজ মোহান্তিদের কথায়, চার বোনই শীর্ণকায়। রাস্তায় বেরোলেই পড়ে যেতেন। দিন কয়েক আগে অ্যাম্বুল্যান্সে করে এক বোনকে হাসপাতাল নিয়ে যেতেও তাঁরা দেখেছেন। কিন্তু কখন হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে এনে বাড়িতেই মৃতদেহ তিন বোন আগলে রাখবে তা কল্পনাও করতে পারেননি প্রতিবেশীরা। প্রাথমিক চিকিৎসার পর দুই বোন লিলি ও টুকটুকি বাড়িতে ফিরলেও তাদের কথাবার্তা ও আচরণ অসংলগ্ন। পুলিশের কাছে অবশ্য তপতীদেবী জানান গত বুধবার রাতে মৃত্যু হয় অর্চনার। কিন্তু পুলিশের বক্তব্য এত কম সময়ে মৃতদেহে এভাবে পচন ধরবে না। তদন্তকারীদের বক্তব্য ঠিক কবে অর্চনাদেবীর মৃত্যু হয় এবং মৃত্যুর কারণ কী তা ময়নাতদন্তের পরেই নিশ্চিত হওয়া যাবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.