স্টাফ রিপোর্টার: প্রথম সূত্র মিলেছিল নিহত যুবতীর মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন থেকে৷ দ্বিতীয় সূত্র দিয়েছিল হোটেলের চাদর৷ তৃতীয় সূত্রটি পাওয়া গিয়েছিল ট্রাফিক পুলিশের সিসিটিভি থেকে৷ এ ছাড়াও যে হোটেলের সামনে যুবতীর দেহ ফেলে দেওয়া হয়, সেই হোটেলের কয়েকজন কর্মীর কাছ থেকেও মেলে বেশ কিছু তথ্য৷ পর পর এই সূত্রগুলি জুড়েই পুলিশ নিশ্চিত হয় যে, হোটেলের ভিতর খুন করেই সামনের ফুটপাথে ফেলে দেওয়া হয় যুবতীকে৷ এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হোটেলের ম্যানেজার নিজেই৷ রবিবার রাতে হুগলির পান্ডুয়ার বাড়ি থেকে হোটেল ম্যানেজারকে আটক করে পার্ক স্ট্রিট থানায় নিয়ে আসা হয়৷ ম্যানেজারের বক্তব্যে দেখা যায় প্রচুর অসংগতি৷ সোমবার দুপুরে সোমেন মিত্র নামে ওই ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করে৷ তাকে জেরা করে পুলিশ জানতে পারে যে, হোটেল ম্যানেজার হোটেলেরই এক মহিলা কর্মী কদবানু বিবির সাহায্য নিয়ে পাচার করেছিল দেহ৷ গ্রেফতার করা হয় ওই মহিলা হোটেলকর্মীকে৷ ওই হোটেল ম্যানেজারকে জেরা করেই সন্ধান মেলে আসল খুনির৷ রাতেই রিজওয়ান নামে ওই যুবককে পুলিশ ধরে ফেলে৷ পার্ক স্ট্রিট থানায় তাকে জেরা করার পর উঠে আসে বহু তথ্য৷ যদিও ওই হোটেল ম্যানেজার যুবতীকে খুন করেছে, সেই বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত না হলেও যুবতীর দেহ সরিয়ে ফেলা ও প্রমাণ লোপাটের পিছনে যে ওই ব্যক্তিই রয়েছে, সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই পুলিশের৷ আবার পুলিশের মতে, মূল খুনের অভিযুক্ত রিজওয়ান হলেও তার সঙ্গে আরও একজন থাকতেও পারে৷ মঙ্গলবার খুনের মূল অভিযুক্ত রিজওয়ানকে গ্রেফতারের পর তাকে আদালতে তোলা হবে৷ একইসঙ্গে ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলা হবে হোটেলের মহিলা কর্মী কদবানু বিবি ও হোটেল ম্যানেজার সোমেন মিত্রকেও৷
পুলিশ জানিয়েছে, গত শনিবার ভোর রাতে যখন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের হোটেলের সামনে যুবতীর দেহ উদ্ধার হয়, তখন তদন্ত শুরু করে পুলিশ আধিকারিকরা দেখেন যে, হোটেলের সিসিটিভি খারাপ৷ এতে পুলিশের সন্দেহ হয়৷
জেরার মুখে ধৃত হোটেল ম্যানেজার পুলিশকে জানিয়েছে যে, হোটেলের মালিক বহুদিন ধরেই পক্ষাঘাতে ভুগছেন৷ তিনি হোটেলের উপর বেশি নজর দিতে পারেন না৷ বরং তিনি বিশ্বাস করতেন হোটেল ম্যানেজার সোমেন মিত্রকে৷ ওই ব্যক্তি সেই সুযোগ নিয়ে বেআইনি ব্যবসা শুরু করে৷ বহু যুবক ও যুবতীর পরিচয়পত্র না দেখেই তাঁদের হোটেলের ঘর ভাড়া দিত সে৷ এমনকী, কোনও যুবক ও যুবতী যদি কয়েক ঘণ্টার জন্য হোটেলের ঘর ভাড়া চাইত, তা-ও দিয়ে দিত ম্যানেজার৷ সেই কারণেই সিসিটিভিগুলি বিকল করে রেখেছিল সে৷ গত সপ্তাহে তিনদিন ধরে ওই হোটেলে নিহত তরুণী ও তার এক পুরুষবন্ধু এসে রাত কাটিয়ে পরের দিন সকালে চলে যাচ্ছিল৷ শুক্রবার সন্ধ্যার পরও তারা হোটেলে আসে৷ কিন্তু তাদের পরিচয়পত্র নেয়নি ম্যানেজার৷ তার দাবি, রাত আড়াইটে নাগাদ সবুজ জামা পরা ওই যুবক ম্যানেজারকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জানায় যে, তার সঙ্গিনী আত্মহত্যা করেছে৷ সে ডাক্তার ডাকার নাম করে বেরিয়ে যায়৷ কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার ঘরের ভিতর গিয়ে দেখে যে, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছেন যুবতী৷ পুলিশকে খবর দিলে তাঁর কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যেতে পারে৷ সেই ভয়েই তিনি এক কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে হোটেলেরই একটি চাদর মুড়িয়ে যুবতীর দেহ সামনের ফুটপাথে রেখে আসেন৷ যদিও যে কর্মচারীর নাম তিনি করেছেন, সেই ব্যক্তি বিষয়টি অস্বীকার করেন৷ এতেই সন্দেহ হয় পুলিশের৷ ম্যানেজারের বক্তব্যে প্রচুর অসংগতি উঠে আসার পরই তাকে গ্রেফতার করা হয়৷ পার্ক স্ট্রিট থানার আধিকারিক ও লালবাজারের গোয়েন্দাদের টানা জেরার মুখে সোমেন স্বীকার করে যে, কোনও পুরুষ নয়, এক মহিলার সাহায্যে যে ওই যুবতীর দেহ তুলে নেয়৷ সেই সূত্র ধরেই হোটেলের কর্মী কদবানু বিবিকে গ্রেফতার করে পুলিশ জানতে পারে যে, তাকে মোটা টাকার লোভ দেখায় ম্যানেজার৷ একই সঙ্গে ভয়ও দেখায়৷ তাতেই কদবানু বিবি রাজি হয়ে যায়৷ যদিও ওই যুবককে কেন যেতে দেওয়া হল, সেই প্রশ্নের উত্তরও সোমেন প্রথমে দিতে পারেনি৷
রবিবারই জানা গিয়েছে যে, সোমা দাস নামে নিহত যুবতীর বাপের বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মগরাহাটে৷ তাঁর সঙ্গে কয়েক বছর আগে বিয়ে হয় হুগলির শ্রীরামপুরের বাসিন্দা সমীর দাসের৷ চার বছর আগে দম্পতির এক কন্যাসন্তান জন্ম নেয়৷ তার নাম রিমা৷ যুবতী সোনাগাছির ইমাম বক্স লেনে যৌনকর্মীর কাজ করতেন বলে পুলিশ জেনেছে৷ সেই কারণেই সম্ভবত স্বামীর সঙ্গে গোলমাল সোমার৷ তাঁর দুই হাতে ইংরেজিতে রিমা ও সমীরের নামও লেখা৷ ধৃত খুনের অভিযুক্ত রিজওয়ানকে জেরা করে প্রাথমিকভাবে পুলিশ জানতে পেরেছে যে, তার সঙ্গে যৌনপল্লিতেই সোমার পরিচয় হয়৷ প্রায়ই সোমার ঘরে আসত রিজওয়ান৷ সেই সূত্র ধরে শুধু শারীরিক সম্পর্ক নয়, তাদের মধ্যে মানসিক সম্পর্কও তৈরি হয়৷ সেই সম্পর্কের জেরে সোমা তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন৷ ঝোঁকের মাথায় রাজি হয়ে যায় রিজওয়ান৷ সম্পর্ক বজায় রাখলেও বিয়ের বিষয়টি এড়িয়ে চলতে থাকে রিজওয়ান৷ এদিকে, সোমা ক্রমাগত বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে৷ রিজওয়ান সরাসরি ‘না’ বলে দিলে শুরু হয় ‘ব্ল্যাকমেলিং’৷ সোমা তার বাড়ি়তে বিষয়টি জানিয়ে দেবেন বলে জানান৷ রিজওয়ান চায় সোমার সঙ্গে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে৷ সোমাকে খুন করার ছক কষেই ওই হোটেলে নিয়ে আসে সে৷ হোটেলের ম্যানেজার ও কর্মীরা ছিল তার পরিচিত৷ শুক্রবার দুপুরের পর থেকেই হোটেলে নিয়ে গিয়ে সোমাকে প্রচণ্ড মদ্যপান করায় সে৷ সন্ধ্যার পর তাঁর মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে তাঁকে খুন করে সে৷ একটি দড়ি দিয়ে সিলিংয়ের সঙ্গে সোমার দেহ ঝুলিয়ে দেয় রিজওয়ান৷ ম্যানেজার জানিয়েছে, সে ঝুলন্ত অবস্থায় যুবতীর দেহ দেখেছিল৷ সে জানত না যে, খুন করা হয়েছে যুবতীকে৷ তাই সে দেহ সরায়৷ রিজওয়ানের সঙ্গে মুখোমুখি বসিয়ে পুরো ঘটনাটি জানার চেষ্টা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.