সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: নাগরিক চটকদারি ছেড়ে চিরন্তন ঐতিহ্যের টানে সাজবে দেবী দুর্গার মণ্ডপ। পুজোর কটা দিন সেই সাজে ফিরবে মাটির ঘ্রাণ, লোকসংস্কৃতির প্রাণ। পুরুলিয়ার বিখ্যাত ছৌ মুখোশ দিয়ে মণ্ডপসজ্জা হবে সল্টলেকের সিডি ব্লকের সেন্ট্রাল দুর্গোৎসব কমিটির মহিলা পরিচালিত পুজোর। মহানগর থেকে সেই বার্তা পৌঁছে গিয়েছে ছৌ-এর দেশে। সাজো সাজো রব সেখানেও। সাজিয়ে দেওয়ার জন্য নিজেদের সাজিয়ে তোলা। পুরুলিয়া শহরের নামোপাড়ার দুই তরুণ মুখোশ শিল্পী দিনরাত এক করে এখন মুখোশ তৈরিতে ব্যস্ত।
সময় একটু একটু করে কমে আসছে। প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট গুনে গুনে কাজ করতে হবে। কারণ, মহালয়ার আগেই যে পুরুলিয়া থেকে ছৌ মুখোশগুলো পৌঁছে দিতে হবে সল্টলেকের সিডি ব্লকে। সঞ্জয় আর সানির তাই এখন দম ফেলার ফুরসত নেই। যদিও একাজে দুই ভাইকে সাহায্য করছেন প্যারিস ফেরত শিল্পী বাবা সুনীল শীল। ছোটবেলা থেকে বাবাকে দেখেই দুজনের এই হস্তশিল্পের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। আর মুখোশ শিল্পী বাবা ছেলেদের আগ্রহ মিটিয়েছেন নিজে হাতে তাঁদের মুখোশ নির্মাণ শিখিয়ে। ছৌ-এর আদলে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ পালায় যেভাবে আবির্ভূতা হন দুর্গতিনাশিনী ও তাঁর পরিবার, সেই রূপেই ছৌ মুখোশের অঙ্গসজ্জা করছেন দুই ভাই। এর জন্য সল্টলেকের ওই পুজো কমিটির কাছ থেকে ৬৫ হাজার টাকার বরাত নিয়েছেন তাঁরা।
সঞ্জয় ও সানির কাজের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী, লক্ষ্মীকে নিয়ে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র আদলে ভরা দুর্গার সংসার। এছাড়া উমার আরও একটি মূর্তি তৈরি। এই মূর্তিটি মণ্ডপের একেবারে প্রবেশদ্বারে শোভা পাবে। এছাড়া ছৌ মুখোশের আদলে তৈরি হয়েছে অভিমন্যু, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ, জয়দ্রথরা। কারণ, মণ্ডপসজ্জায় থাকবে ‘অভিমুন্য বধ’ পালার ছোঁয়াও। দুটি মহিষাসুরের মূর্তিও দুজন তৈরি করেছেন দুই শিল্পী। ছৌ শিল্পী সঞ্জয় শীলের কথায়, “প্রায় বছর দুয়েক পর ছৌ নাচের থিমের বড় কাজ পেলাম মহানগরে। ভাল করে ফিনিশিং দিয়ে এই কাজটা শেষ করা এখন আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ।”
এবার পুরুলিয়ায় ছৌ–এর আঁতুড়ঘর চড়িদায় মুখোশ শিল্পীরা সেভাবে কোনও কাজের বরাত পাননি। তাই আগমনির সুরেও বিষণ্ণতাই বাজছে এখানে। কিন্তু পুরুলিয়া শহরে উলটো ছবি। অন্তত এই দুই তরুণ মুখোশ শিল্পী বরাত পাওয়ায় খুশি তাঁরা। নামোপাড়ার বাসিন্দা তথা সাংস্কৃতিক কর্মী সুদিন অধিকারী বলেন, “এবার পুজোয় ছৌ নাচের থিমের সেভাবে বরাত নেই। তার মাঝেই ছৌ মুখোশ শিল্পী এই দুই ভাই বড় কাজের সুযোগ পেলেন। এই হস্তশিল্পের প্রসারে সরকারকে আরও প্রচার করে তুলে ধরতে হবে। তাহলে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা আরও বেশি করে কাজ পাবেন।”
সল্টলেক ছাড়াও মুখোশ শিল্পী সঞ্জয় ও সানি শিয়ালদহের একটি পুজোতেও একাধিক দুর্গার মুখোশ বানানোর বরাত পেয়েছেন। সেই কাজও চলছে একসঙ্গে। তাঁদের বাবা সুনীল শীল বলেন, “এই হস্তশিল্পের কদর এখন বিদেশেও রয়েছে। আমি একটি কর্মশালায় প্যারিস গিয়েছিলাম। কিন্তু বাংলায় সেভাবে কাজের সুযোগ আসছে না। এটাই কষ্টের। তবুও ওদের বলি, কাজ চালিয়ে যা। শিল্পকলার সুদিন আসবেই।” বাবার কথায় ভরসা রেখে সেই সুখের দিনের আশাতেই দুর্গা গড়েন দুই ভাই।
ছবি: সুনীতা সিং।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.