গৌতম ব্রহ্ম: প্রসবযন্ত্রণা আর শোনা যায় না৷ সদ্যোজাতর কান্না ধাক্কা খায়না লেবার রুমের দেওয়ালে৷ বরং রাত বাড়লেই শুরু হয় শিয়ালের চিৎকার৷ বৃষ্টি হলে ইন্ডোরে ঘুরে বেড়ায় জলঢোঁড়া, খরিশ৷
উত্তর কলকাতার পাইকপাড়ার ইন্দিরা মাতৃসদনে গেলে এই দৃশ্যই চোখে পড়বে৷ ডাক্তার রয়েছেন৷ নার্স রয়েছেন৷ সুপার আছেন, নার্সিং সুপার, সিস্টার-ইন-চার্জ আছেন৷ শুধু রোগী নেই৷ খাঁ খাঁ করছে ৩০ শয্যার হাসপাতাল৷ সকালের দিকে একজন ডাক্তার বসেন৷ কোনওদিন রোগী হয়, কোনওদিন হয় না৷ প্রতিষেধক দেওয়া বা পোলিও খাওয়ানোর দিনেই একমাত্র ভিড় হয়৷ সাত বছর ধরে এমনটাই চলছে৷
অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়৷ ২০০৯ সালে ইন্দিরা মাতৃসদনের টিঁকি আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়৷ সিজার করার জন্য তৈরি করা হয় আধুনিক অপারেশন থিয়েটার৷ ঢেলে সাজা হয় অন্তবির্ভাগ ও লেবার রুম৷ কথা ছিল, আরজি করের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা এসে এখানে এসে রোগী দেখবেন, সিজার করবেন৷ কিন্তু কোথায় কী! তৈরি হওয়ার পর একদিনের জন্যও ওটির আলো লাল হয়নি৷ বরং বন্ধ হয়ে গিয়েছে নর্মাল ডেলিভারি৷ রোগী ভর্তিও বন্ধ হয়ে যায় সেই বছর থেকে৷ এমনটাই জানালেন হাসপাতালের গ্রুপ ডি কর্মী শঙ্কর মল্লিক৷ তীব্র হতাশা শঙ্করবাবুর গলায়৷ জানালেন, “ওই বছরই আমি কাজে যোগ দিই৷ আর ওই বছরই রোগী ভর্তি বন্ধ হয়ে যায়৷” একই বক্তব্য হাসপাতালের কর্মী কোয়েলপতি দাসের৷ বিহারের এই বাসিন্দা ১৯৭৫ সাল থেকে এই হাসপাতালে চাকরি করছেন৷ জানালেন, আগে হাসপাতাল গমগম করত৷ কত রোগী, কত শিশু৷ সন্তান লাভের আনন্দে কত মানুষ মিষ্টি বিলি করতেন৷ আর এখন সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেই শুনশান হয়ে যায় মাতৃসদনের ক্যাম্পাস৷ গলা ধরে আসে কোয়েলপতির৷
হাসপাতালের মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই বাঁদিকে চোখে পড়ল ‘বিপজ্জনক’ ঘোষিত হওয়া ভাঙাচোরা একটি দোতলা কর্মী আবাসন৷ জনস্বাস্থ্য কারিগরী দফতরের অফিস৷ ডানদিকে ডাক্তারদের থাকার কোয়ার্টার৷ ডাক্তাররা অবশ্য এখানে আর কেউ থাকেন না৷ শঙ্করবাবুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কাশীনাথ পাল নামে এক চিকিৎসক সকাল সাড়ে দশটায় আউটডোরে আসেন৷ দেড়টা-দুটো পর্যন্ত আউটডোরে বসে থাকেন৷ কোনওদিন রোগী হয়, কোনওদিন হয় না৷ একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ‘ইমার্জেন্সি’-তে বসেন৷ নিয়ম করে হাসপাতালে আসেন সুপার ডা. শঙ্করপ্রসাদ মণ্ডলও৷ কর্মীদের দাবি, সুপার অনেক চেষ্টা করেছেন হাসপাতালটিকে আগের মতো সচল করার৷ কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর তেমন আগ্রহ দেখায়নি৷ আগ্রহ দেখায়নি আরজি কর হাসপাতালও৷ জানা গিয়েছে, মাতৃসদন হাতে নেওয়ার পরই আর জি করের হাতে আসে বি কে পাল অ্যাভিনিউর অবিনাশ দত্ত মেটারনিটি হোম৷ দু’জায়গায় ডাক্তার দেওয়া সম্ভব ছিল না আর জি করের পক্ষে৷ তাই মাতৃসদনে রোগী ভর্তি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়৷ আর জি করের অধ্যক্ষ ডা. শুদ্ধোধন বটব্যাল জানিয়েছেন, হাসপাতালটি নিয়ে স্বাস্থ্যভবন নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে৷ একটি বিশেষ ক্লিনিক খোলার চিন্তাভাবনা চলছে৷ একই বক্তব্য রাজ্যের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা (শিক্ষা) ডা. সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের৷ জানালেন, হাসপাতালটির পুনরুজ্জীবনে একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে৷ তাদের সুপারিশ মেনেই যা করার করা হবে৷
১৯৭৫ থেকে যাত্রা শুরু ইন্দিরা মাতৃসদনের৷ রাজা মণীন্দ্র স্ট্রিটের উপর সাড়ে তিন বিঘা জমির উপর তৈরি হয় দেড়তলা হাসপাতাল৷ ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপন করেন অজিত পাঁজা৷ উদ্বোধন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়৷ ভালই চলছিল৷ ক্যাম্পাসের ভিতরে-বাইরে ছিল অ্যাম্বুল্যান্সের ভিড়৷ ২০০৯ সালে আর জি করের হাতে যাওয়ার পরই ছবিটা বদলে যায়৷ এখন রাত বাড়লেই এখানে আশপাশের জঙ্গল হানা দেয় শিয়ালের দল, বনবিড়াল৷ শঙ্করবাবু জানালেন, রাতে বাইরে বেরোতে ভয় লাগে৷ শিয়ালের এত চিৎকার৷ প্রায় দশ-পনেরোটি শিয়াল রয়েছে৷ সাপের উপদ্রবও রয়েছে৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.