চারুবাক: তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা আজ নয়, অনাদিকাল থেকেই এই সমাজে অন্ত্যজ শ্রেণির পরিচয় নিয়ে গ্লানির জীবন কাটাচ্ছে। আমরা, সাধারণ মানুষ শিক্ষিত হয়েছি বটে, কিন্তু আজও অন্ত্যজ শ্রেণির এই মানুষগুলোকে নিজের প্রতিবেশী মানতে পারছি না। এখনও এঁদের ‘হিজড়ে’ , ‘ছক্কা’ নামে অবজ্ঞা, অবহেলার সুরেই ডাকি এবং তেমন ব্যবহার করি অধিকাংশ সময়।
সমাজের এই প্রান্তিক মানুষগুলো যদিও সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে, কিন্তু যথার্থ সামাজিক স্বীকৃতি এখনও আমরা দিয়ে উঠতে পারিনি। নিকট ভবিষ্যতেও পারব কিনা হলফ করে বলতে পারি না। এই কলকাতা শহরে কি ভাগ্যিস ঋতুপর্ণ ঘোষ (Rituparno Ghosh) নামের একজন ‘বিদ্রোহী’ ক্ষণিকের জন্য এসেছিলেন। তাই চিত্রটা খানিক বদলেছে। কিন্তু সার্বিক বদল নেই।
এমন প্রেক্ষিতে মহেশ দাত্তানির লেখা ইংরেজি নাটক থেকে বঙ্গীকরণ ঘটিয়ে একটি সুন্দর সাজানো গল্পের মধ্যে একঝাঁক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সমস্যা শুধু নয়, তথাকথিত সভ্য জগতের সব শ্রেণির মানুষরাই কী নির্মম, নৃশংসভাবে তাঁদের ব্যবহার করে চলেছি তার একটি বাস্তব ছবি তুলে এনেছে মঞ্চে। নাট্যকার পিয়ালী চট্টোপাধ্যায় শুধু ওদের দিকেই চোখ রাখেননি, তাঁর কলম ও চোখ পড়েছে আজকের দুর্নীতির রাজনীতি বা রাজনীতির দুর্নীতির দিকেও।
পুলিশ এবং ক্ষমতাভোগী নেতারা যে একে অপরের হাতের দস্তানার মতো বন্ধু হয়ে কাজ করে সেটা দর্শকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। জানি না, তবুও দর্শক সচেতন হবেন কিনা। না, নাটকের গল্প বা কাহিনির বর্ননায় যাচ্ছি না। শুধু এটুকু বলি, প্রভাবশালী মন্ত্রী থেকে তাঁর পোষা আইপিএস পুলিশ অফিসার প্রয়োজনে এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের যেমন অশালীন কাজে, তেমনই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যও ব্যবহার করে। আবার, ঠিক সময়ে রিভলবারের ট্রিগারে হাত রাখতেও কোনও চিন্তা করে না। কারণ তারা জানে ক্ষমতা হচ্ছে ‘মধুচক্র’ আর রাজনীতি হচ্ছে ‘মধুশালা’।
নির্দেশক বলেছেন নাটকটি ‘মিউজিক্যাল থ্রিলার’। হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে গান আছে, বেসুরো হলেও। কিন্তু ‘মিউজিক্যাল’ কখনই নয়। কিঞ্চিৎ থ্রিলার এলিমেন্ট অবশ্যই আছে। আর আছে কঠিন বাস্তব। এক গুরুমা চম্পার সংসারে ফুলকি, বিজলির মতো আরও চার-পাঁচজন কিন্নর। অন্যদিকে, দুর্নীতির নেতা তথা মন্ত্রী সুভদ্র ও তাঁর ডান হাত পুলিশ অফিসার সুমন। নাটকের মধ্যে অফিসারের স্ত্রী গবেষক অদ্রিকার প্রবেশ যেন মৌচাকে ঢিল ছুঁড়ে ফেলে। জমজমাট নাটক, কিঞ্চিৎ দীর্ঘও বটে।
নির্দেশক তীর্থংকর চট্টোপাধ্যায় অবশ্য তাঁর প্রয়োগ কৌশলে তেমন কোনও পরীক্ষার পথে না গিয়ে সোজাসাপটা ভঙ্গিতেই ঘটনা এগিয়ে নিয়েছেন। শুধু বিজলির ‘মৃত্যু’ নিয়ে নাটক করার চেষ্টা রয়েছে। আর চম্পার চরিত্রে পিয়ালি চট্টোপাধ্যায় নিজেই একটু ‘অতিরিক্ত’ হয়ে উঠেছেন দু’টি জায়গায়। এক-মন্ত্রীর সঙ্গে তর্কে, দুই – মৃত্যুর দৃশ্যে। অদরিকর চরিত্রে মোনালিসা দর্শকের সঙ্গে কথোপকথনের সময় যেমন সংযত, সাবলীল, আবার অন্যান্য সময় তিনি প্রতিবাদীর হয়ে ওঠার মুহূর্তগুলোতে কিঞ্চিৎ নাটকীয়তা করেও স্বাভাবিকতা বজায় রাখেন।
মন্ত্রীর চরিত্রে নির্দেশক তীর্থংকর চট্টোপাধ্যায় বেশ দাপুটে মেজাজেই কাজ করেছেন। পুলিশ অফিসার হয়ে অতনু চট্টোপাধ্যায় কিন্তু আরও মেজাজি হতে পারতেন। ফুলকির মত ছোট্ট চরিত্রে অনিন্দ্য রায় মন্দ করেননি। মহেশ দত্তানির নাটক আমরা দেখলাম না, দেখলাম পিয়ালী চট্টোপাধ্যায়ের “একটি (অ)সামাজিক প্রেমের গল্প” যেখানে বলা হলো দুর্নীতির সমুদ্রে বাস করা এই সমাজ, কে দেবে সাজা, কে পায় সাজা, ক্ষমতাই এখানে রাজা”! এমন আকাট ‘সত্যি’ আজকের ক’টা বাংলা নাটক বলছে। কার্টেন কল (Curtain Call) সাহস করে অন্তত কিছুটা বললো।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.