ভাস্কর লেট: অভিনয় দিয়েছে অফুরন্ত আত্মবিস্তারের সুযোগ৷ আর, লেখার টেবিল দিয়েছে অনায়াস আরাম৷ অভিনয়ের প্রয়োজনে কথা বলতে ভালই লাগে৷ কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে, চেনা বন্ধুবৃত্ত ব্যতীত, জনসমক্ষে কথা বলার মধ্যে প্রাণের সেই স্ফূর্তি অনুভব করেন না, যা গানের আখরের মতো ঘুরে-ঘুরে আসে প্রতিবারই লেখার সামনে গিয়ে বসলে৷
‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর উদ্যোগে ‘নন্দন ১’ প্রেক্ষাগৃহে ‘গদ্যসংগ্রহ’র দু’টি খণ্ড প্রকাশ উপলক্ষে অকপটে নিজেকে উন্মোচন করলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷ এবং তা শুনে প্রধান অতিথি, যাঁর হাতে মোড়কমুক্ত হল গদ্যসংগ্রহর দু’টি রাজসিক খণ্ড, সেই নাসিরুদ্দিন শাহ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ঘাড় নেড়ে নীরবে প্রশংসা না-করে যেন পারলেন না৷ এই তারিফ, হলই-বা নিরুচ্চার, শব্দহীন, প্রায় অলক্ষ্য – তবু সমগ্র অনুষ্ঠানটিকে একলহমায় উত্তীর্ণ করে দিল মনখুশির সেই উত্তুঙ্গ মার্গে–যার প্রত্যাশায় সমবেত হয়েছিলেন অগণিত মানুষ৷
আবারও একবার ফিরে আসা যাক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায় .. ‘অভিনয় দিয়েছে আত্মবিস্তার, লেখা দিয়েছে আরাম’৷ এহেন আত্মোপলব্ধি ভাবীকালের লাল পেনসিলের খর নিবের তলায় দু’টি কারণে স্মরণযোগ্য হয়ে থাকবে৷ প্রথম কারণটি হল … আজও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অধিকাংশ বাঙালির কাছে মূলত ‘অভিনেতা’ রূপে পরিচিত, বন্দিত৷ কিন্তু অভিনয়ের পাশাপাশি নন্দনকলার অন্য ক্ষেত্রেও যে তাঁর অবাধ ও নিরন্তর যাতায়াত জারি থেকেছে সেই যৌবনের দিন থেকে অদ্যাবধি – তা জানেন ক’জন?
সেই বাস্তব উপাখ্যান যে আড়ালেই থেকেছে বরাবর৷ ফলে কখন, কোন অবকাশে, কী করে দু’টি খণ্ডে ছাপা হওয়ার মতো এত বিপুল পরিমাণ গদ্য তিনি রচনা করে ফেললেন, সে-প্রশ্ন বিস্ময়ের বইকি! দ্বিতীয় কারণটি আরও চমকপ্রদ৷ ‘চলচ্চিত্রাভিনেতা’ রূপে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তুমুল খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও গজদন্তমিনারে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি৷ বরং নিজের শিল্পীসত্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন রসিক দর্শকের দরবারে৷
তারকামহিমা কখনওই তাঁকে কূপমণ্ডুক, আত্মস্বার্থসর্বস্ব ‘স্টার’-এ পরিণত করতে পারেনি৷ তারকালক্ষণ থেকে সযত্নে নিজেকে বিমুক্ত রাখার এই যে প্রয়াস, সৌমিত্রবাবু মতে, তাঁর লেখালিখির সঙ্গে দূরত্ববোধ ঘুচিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সেই মানসপ্রবণতার একটি নিবিড় যোগ আছে৷ তিনি মনে করেন … কাজের সূত্রে, বেঁচে থাকার সূত্রে যেসব অভিজ্ঞতা তাঁকে আত্যন্তিকভাবে ছুঁয়ে গিয়েছে, যেসব মানুষের সংস্পর্শ আনখশির প্রভাবিত করেছে, লেখার সময় সেই-সেই অভিজ্ঞতা ও মানুষগুলিই প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে মায়াঘন ছায়া বিস্তার করেছে৷ তাই কখন এত লেখা লিখলেন সেই কথা স্পষ্ট করে মনে না পড়লেও গদ্যগুলি লেখার সময় আত্মসচেতন ছিলেন না – এমনটা হয়নি আদৌ৷
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানটির সূচনা ঘটে ‘নন্দন ১’ প্রেক্ষাগৃহে একটি চিত্রপ্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে৷ একদিনব্যাপী এই এগজিবিশনের উদ্বোধন করেন বরেণ্য কবি শঙ্খ ঘোষ এবং অতুলনীয় কৌতুকরসের আশ্রয়ে বলেন … ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একাধারে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রাভিনেতা, কবি, নাটককার, সাময়িক পত্রিকার সম্পাদক, গায়ক৷ এত বিচিত্র শাখায় এত স্বাচ্ছন্দ্যে অন্য কাউকে বিচরণ করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না৷ আমরা তো ওঁকে ব্যক্তিগত আড্ডায় নাচতেও দেখেছি৷’ এগজিবিশনটি সত্যিই অত্যন্ত দুর্লভ চিত্রসম্ভারে সেজে উঠেছিল৷ তাতে সিনে-পোস্টার, সিনে-পুস্তিকা ছাড়াও ঠাঁই পেয়েছে সৌমিত্রবাবুর নিজের আঁকা একাধিক ছবি৷
এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এমন কয়েকজন গুণী ব্যক্তিত্ব যাঁরা দীর্ঘকাল ধরে বন্ধু ও স্বজন রূপে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে চেনেন, জানেন৷ যেমন পবিত্র সরকার, যোগেন চৌধুরী, অনিতা অগ্নিহোত্রী প্রমুখ৷ বইপ্রকাশের আগে এঁরা সংক্ষিপ্ত দু’-চার কথায় সৌমিত্রবাবুর লেখার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন – যা সার্বিকভাবে তাঁর শিল্পীচৈতন্যকে নতুন করে বুঝতে সহায়তা করে৷ শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন যে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আত্ম-পরিতৃপ্তির অভাব দেখে তিনি মুগ্ধ৷ যে-মানুষটি শিল্পী রূপে এতখানি দৃঢ়চেতা, সেই মানুষটিই কী করে এত উদাসীন, স্টারডম-বিচ্যুত জীবন অতিবাহিত করতে পারেন, তা চোখের সামনে না-দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত৷
লরেন্স অলিভিয়ারের অভিনীত থিয়েটার দেখার পরেও পবিত্র সরকার অভিনয়-নৈপুণ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে এগিয়ে রাখবেন৷ হতে পারে এই মূল্যায়ন জাত্যভিমান–পুষ্ট, এক বাঙালির আরেক বাঙালির কৃতিত্বে উচ্ছসিত হয়ে পড়ার মতো ব্যাপার৷ কিন্তু এটাও তো মনে রাখতে হবে যে সৌমিত্রবাবু আনুপূর্বিক বাঙালিই থেকে গিয়েছেন – শিক্ষিত, আত্মাভিমানী বাঙালি, যিনি বাংলায় কথা বলতে না-পারলে বিমর্ষ বোধ করেন৷
যোগেন চৌধুরী তুলে ধরেন শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অঙ্কনপ্রতিভার কথা৷ প্রথাসিদ্ধ তালিম না-থাকা সত্ত্বেও ওঁর আঁকা ছবিতে তিনি সন্ধান পেয়েছেন অরূপের মাধুর্য, যা ‘রিয়ালিস্টিক স্কিল’-কে অতিক্রম করে ম্যাজিক মোমেন্টসের জন্ম দেয়৷ কথাসাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রীর মতে, গদ্যরচয়িতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সবরকমের আত্মসচেতন চতুরালি থেকে শত হস্ত দূরে অবস্থান করেন৷ অনিশ্চয়তার দোলাচলের যে ফাঁদ প্রতি পলে গদ্যলেখককে সাধনা থেকে দূরবর্তী করে দেয়, সেই ভ্রান্তিপাশ গদ্যলেখক রূপে সৌমিত্রবাবু জয় করতে পেরেছেন৷ আর, ওঁর কবিসত্তার মধ্যে অনিতা খুঁজে পেয়েছেন শুতম, অবিমিশ্র মৌলিক এক কন্ঠস্বর৷ যা নির্জনতার পূজারী, আবার চিত্ররূপময়ও৷
অনুষ্ঠানের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ৷ কথোপকথনের পুরোটা পর্ব জুড়ে যিনি ‘সৌমিত্রদা’ বলে আন্তরিক সম্মান জ্ঞাপন করলেন তাঁর সমকালীন এক অগ্রজ অভিনেতাকে৷ বইপ্রকাশের পর বিশিষ্ট সমালোচক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি আলোচ্য গদ্যসংগ্রহর অন্যতম প্রধান সম্পাদক, নাসিরুদ্দিন শাহ এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে একটি খোলামেলা টক-শো সংগঠিত করেন৷ নাসিরুদ্দিন শাহ অভিনেতা রূপে বরাবর ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, ভেঙেছেন – আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন আবহমান ঐতিহ্যের প্রতি৷
দুই দিকপাল অভিনেতা সম্বন্ধে এই মূল্যায়ন কি প্রযোজ্য? শমীকবাবুর প্রশ্নের উত্তরে নাসিরুদ্দিনের প্রথম প্রতিক্রিয়াই ছিল … হ্যাঁ, বলা চলে৷ আমি মনে করি সৌমিত্রদা আমার চেয়ে অনেক বেশি সেরিব্রাল, বুদ্ধিদীপ্ত৷ অন্যদিকে, আমি অনেক বেশি সাহসী ও বেপরোয়া৷ ওই টক-শো’তেই নাসিরুদ্দিন বলেন … অভিনয় করা, কি থিয়েটারে কি সিনেমায়, অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ৷ পান থেকে চুন খসলে সবাই রঙ্গব্যঙ্গ ও সমালোচনা করেন৷ কিন্তু ভুল ধরিয়ে দিতে কেউ এগিয়ে আসেন না৷ আর সেই কথার পিঠেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আক্ষেপ … নতুন কিছু পড়া, জানা ও শেখার আগ্রহ ক্রমশ কমছে৷ বাংলায় এই মুহূর্তে যাঁরা অভিনয় করছেন তাঁদের অনেকে ভাল করে বাংলা-ই বলতে পারেন না৷
শুধু লিখলেই হয় না৷ লিখিত ও প্রকাশিত লেখা দু’মলাটের আধারে একত্র হওয়াও জরুরি৷ নইলে লেখকের চলন, তাঁর ভাবনার বিস্তার, অগ্রগতির পটভূমি ও অন্তর্দৃষ্টির আলো পাঠককে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কী করে? ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর উদ্যোগে, পি. সি. চন্দ্র জুয়েলার্সের সহযোগিতায় ও দে’জ প্রকাশনার পরিপূরক তত্ত্বাবধানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যে-গদ্যসংগ্রহ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হল, তা বাংলা ভাষার একজন মননশীল, সক্রিয় লেখকের পথচলার ইতিবৃত্ত উত্তরকালের পাথেয় রূপে করতলে ধারণ করে রাখবে তাতে সন্দেহ নেই৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.